Thursday, July 30, 2009

সাজ্জাদ শরীফ এবং রণজিৎ দাশের সম্পাদিত শ্রেষ্ট কবিতা সংকলন বিষয়ে সুমন রহমানের নোট বিষয়ে কিছু কথা


সাজ্জাদ শরীফ এবং রণজিৎ দাশের সম্পাদিত শ্রেষ্ট কবিতা সংকলন বিষয়ে সুমন রহমানের নোট বিষয়ে কিছু কথা

তুষার গায়েন

ধরা যাক দু'একটা ইঁদুর এবার

আলোচিত সংকলনটি নিয়ে সুমন রহমান তার একটি নোটে আমাকে ট্যাগ করেছেন। সুমন রহমানের নোট নিয়ে অনেক আলোচনা, মন্তব্য চোখে পড়লো। সংকলনটা যেহেতু হাতে নেই এইসব আলোচনা, মন্তব্যের সূত্র ধরে কথা বলতে হচ্ছে। সুমন রহমানের নোট থেকে জানতে পারলাম যে বাংলাদেশের কবিতার বিষয়ে সাজ্জাদ শরীফের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।…’সাজ্জাদ শরিফ বলছেন আশিপূর্ব কবিতা "ইতিহাসের দায় মিটিয়েছে সত্য, কিন্তু কবিতার যথাযথ দায় মেটাতে পারেনি। আভিধানিক অর্থ থেকে শব্দের যে বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে কবিতার সূচনা ঘটে, কবিতাকে এবার তার সেই ভাষা-সংবেদনার কাছে নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় এ সময়ের কবিরা ষড়যন্ত্রময়’।সুমন রহমানের পরবর্তী আলোচনা থেকে এই কথার ব্যাখ্যা পেলাম যে, সাজ্জাদ শরীফ আশি-পূর্ব কবিতাকে অকবিতার কাল এবং আশি-পরবর্তী কবিতাকে কবিতার কাল মনে করেন, ‘যে কালক্রমকে আপনি প্রকারান্তরে বলছেন "অকবিতা"র কাল সেখানে আপনি লিবারাল, আবার যখন থেকে "কবিতা" শুরু হয়েছে বলে বলছেন সেখানটায় এসেই আপনি কনজারভেটিভ হয়ে গেলেন।"
সাজজাদ শরীফের এ ধরনের মূল্যায়নের ভিত্তি কী? ইতিহাসের দায় মেটানো বলতে তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন? ইতিহাসের দায় মিটিয়ে লেখা কবিতা কবিতা হয় না, এটাই কি তার বলবার বিষয়? ইতিহাসের দায় মেটানো বলতে তিনি যদি কবিতার রাজনীতি-সংলগ্নতা বুঝিয়ে থাকেন এবং তাকে গৌণ (inferior) জ্ঞান করেন, তবে তার পিছনে যুক্তি কি? পৃথিবীতে সব কালে, সব দেশে কবিতার ইতিহাস ও রাজনীতি সংলগ্নতা একটি স্বাভাবিক ও সার্বজনীন বিষয়। বিশেষ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক পটভূমিতেই যে মহৎ কবি ও কবিতার জন্ম হয়, সেটা কি সাজ্জাদ শরীফ জানেন না? পাবলো নেরুদা, ফেদোরিকা গার্সিয়া লোরকা, নাজিম হিকমত, পাউল সেলান, সিমাস হিনি, কাজী নজরুল ইসলাম ও আরো কত শত কবি যে ইতিহাসের দায় মিটিয়ে বড়ো কবি সেকথাতো স্কুলের শিশুরাও জানে। বাংলাদেশ কি তার ব্যতিক্রম? বাংলাদেশের কবিতা বলতে আজ বাংলাদেশী পাঠক ও বিশ্ব পাঠক যা বোঝেন, তার উদ্ভব ও বিকাশ ইতিহাসেরই গর্ভে। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের ভিতর দিয়ে পাকিস্তানী দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রত্যাখ্যান ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েইতো বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও কবিতার বিপুল, বিচিত্রময় বিকাশ সম্ভব হয়েছে। এটাইতো ইতিহাস। বাংলাদেশের বহু বিখ্যাত কবিতা রাজনীতি ও ইতিহাসের দায় মিটিয়ে শিল্পোত্তীর্ণ ও ক্লাসিক। শামসুর রাহমানের বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, আসাদের শার্ট, স্বাধীনতা তোমাকে পাবার জন্য; সিকান্দার আবু জাফরের বাংলা ছাড়ো, শহীদ কাদরীর স্কিজোফ্রেনিয়া, নির্মলেন্দু গুণের হুলিয়া, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কোনা এক মাকে, আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, বৃষ্টি ও সাহসী মানুষের জন্য প্রার্থনা, আসাদ চৌধুরীর বারবারা বিডলারকে ও আরো কতো কবিতা, লিস্ট দিলে তো অনেক লম্বা হয়ে যাবে। আশি ও নব্বইয়ের কোনো কোনো কবি শিল্পোত্তীর্ণ রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন, সাজ্জাদ শরীফ হয়তো তা অকবিতা মনে করেন। কবিতা রাজনৈতিক হবে না ঐতিহাসিক হবে না ব্যক্তিগত জ্বালা যন্ত্রণার হবে, তার উপর কবিতার মান নির্ভর করে না। যে কোনো বিষয়ে কবিতা লেখা হতে পারে এবং কবির মেধা ও সৃষ্টিশীলতাই সেই কবিতার মান প্রদান করে। ৪০ দশক থেকে ৭০ দশক পর্যন্ত এই পর্বে , কবিরা যে শুধু ইতিহাসের দায় মেটাতেই কবিতা লিখেছেন এই কথার বা ভিত্তি কি? এই কালপর্বে (৪০-৭০ দশক) কবিরা পৃথিবীর অন্যান্য কবিদের মতোই জীবনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তা পাঠক জানেন। যেটা হয়েছে, কিছু নিম্নমেধার কবিরা জনপ্রিয়তার লোভে রাজনৈতিক কবিতার নামে শ্লোগান নির্ভর সস্তা কবিতা লিখেছেন। সেগুলো আমরা আমলে নেবো কেন? অইসব কবি ও কবিতাকে রেফারেন্স হিসাবে নিয়ে কি আমরা রাজনৈতিক কবিতার সুদীর্ঘ ইতিহাস অস্বীকার করতে পারি? শামসুর রাহমান লিখেছেন,’তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা আর কতোবার ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়’, আমাদের রক্ত গংগা কি বন্ধ হয়েছে? ৭১-এর রক্ত গংগার পরেও আরো কতোগুলো রক্ত গংগা আমাদের দেখতে হয়েছে। দুদিন আগেই তো দিনে দুপুরে বিডিআরে আরেকটি রক্ত গংগা আমাদের দেখতে হল, তার দাগ কি শুকিয়েছে? বাংলাদেশের মতো সদা বিক্ষুদ্ধ, রাজনৈতিক আবর্তের দেশে বাস করে কবিরা কিভাবে অরাজনৈতিক হবেন এবং ইতিহাসের দায় অস্বীকার করবেন? এ ধরনের দাবীর পিছনে কি কোনো রাজনীতি নেই? আশির দশকে বাংলা কবিতার এমন কি মহান পরিবর্তন অথবা বাক-বদল ঘটেছে যাকে বাংলাদেশে ‘কবিতার শুরু’র কাল বলতে হবে? যে কোনো সাহিত্য ও শিল্প আন্দোলনের পিছনে কোনো দেশ ও জাতির অনিবার্য ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটা বিরাজ করে যা নতুন স্বপ্ন, নতুন চেতনা ও নতুন বুদ্ধিবৃত্তির সূচনা করে, যার উত্তাপে নতুন কবিতা ও সাহিত্যের জন্ম হয়। এগুলো আকাশ থেকে পড়ে না, অথবা কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে বিখ্যাত করার জন্য এমনি এমনি এসে হাজির হয় না। বাংলাদেশের কবিতার ইতিহাস তাই বলে।

ইংরেজ শাসনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে,উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালী সমাজ ইংরেজী শিক্ষা, ডিরোজিওর যুক্তিবাদী চিন্তাপদ্ধতি ( rational thinking)ইউরোপীও এনলাইটেনমেন্ট ও রেঁনেসাঁর সাথে পরিচিত হয়ে যে যুগান্তকারী মানসিক পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তার ফসল বাঙালীর আধুনিকতা ও বাঙালী রেনেসাঁ। কবিতার ক্ষেত্রে এটাই মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিহারী লাল চক্রবর্তী, রংগলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কামিনী রায়, রজনীকান্ত সেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত-র মতো ক্ষণজন্মা কবিদের আবির্ভাব সম্ভব করেছিল। এই বাঙালী রেনেসাঁ নিয়েও সমালোচনা আছে, যা অন্নদা শঙ্কর রায়, শিবনারায়ণ রায় অথবা আজকের পোস্ট মডার্ন/ উত্তর আধুনিক সমালোচকেরা করে থাকেন, সেটা ভীন্ন প্রসঙ্গ। তিরিশের দশকে আমরা আরেক আধুনিকতার রুপ দেখলাম– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, ইউরোপে হাই-মডার্নিজমের যে চর্চা হল( স্যুররিয়ালিজম, ইমপ্রেশনিজম, দাদাইজম, কিউবিজম ইত্যাদি ইত্যাদি) তার প্রভাবে বাঙালী হাই মডার্নিজমের নতুন কাব্য ধারার সূত্রপাত যার পিছনে রবীন্দ্র কাব্য বলয়কে অতিক্রম করে নতুন ধারা নির্মাণের তাগিদ ক্রিয়াশীল ছিল। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী, সুধূন দত্ত এই ধারার প্রধান পুরুষ। এই আধুনিকতা নিয়েও সমালোচনা আছে, সেটা ভীন্ন প্রসঙ্গ। চল্লিশের দশকে মাকর্সবাদী সমাজবাস্তবতার শক্তিশালী ধারায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যসহ অনেক কবি- সাহিত্যিক সাহিত্যের সব শাখাতেই আবির্ভূত হয়েছেন এবং এখনো অনেকে ক্রিয়াশীল আছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, এমন একটি ঐতিহাসিক টার্নিং পয়েন্ট হচ্ছে ৫২-র ভাষা আন্দোলন, যার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালী মুসলিম নিজেদেরকে নতুন ভাবে আবিস্কার করেছিল, যাকে অনেক চিন্তাবিদ বাঙালী মুসলমানের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ বলে অভিহিত করেন, যা ৭১এর মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে পূর্ণতা পায় ও বহমান থাকে। এই ধারাতেই ৫০, ৬০ ও ৭০ দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশ করেছেন ও বিকশিত হয়েছেন, যার প্রাসঙ্গিকতা এখনো সমানভাবে বিদ্যমান। আমি বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের প্রধান কতগুলো ধারার যে উল্লেখ করলাম এবং তার পিছনে যে ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকারণ উল্লেখ করলাম, আশির দশক কি সেই রকম কোনো ধারা সৃষ্টির দাবী করতে পারে? আশির দশক বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবে এক অন্ধকার যুগ। এই সময় এরশাদের সামরিক শাসন চলছিল, এর আগে ৭৫-এ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে, ৮২-তে আরেক রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হয়েছে (যিনি নিজেও সামরিক ছাউনি থেকে এসেছিলেন) ও প্রতি্ক্রিয়াশীল শক্তির উত্থান ঘটছে। এই সময়ে ৭০ দশকের কিছু গৌণ কবি (সকলে নয়) শ্লোগান নির্ভর, সস্তা রাজনৈতিক কবিতা লিখেছেন যা নতুন কবিরা গ্রহণ করতে পারেন নি। কিন্তু এই কথাটি সত্য যে, আশির দশকের আগের দশকের অনেক প্রধান কবি তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাব্য গ্রন্থগুলো এই সময়ে প্রকাশ করেছেন। তাই ঢালাওভাবে কোনো কিছু খারিজ করার কি অর্থ হয়? আশির দশকের কবিরা শুদ্ধ কবিতা লিখতে গিয়ে এমনই কোষ্ঠকাঠিন্যের পরিচয় দিয়েছেন যে, গত ৩০ বছরে কেউ একটি অথবা আধখানা বই পয়দা করতে পেরেছেন! এবং অধিকাংশ কবি এখন আর লিখছেন না। তারা এতই উচ্চ মার্গের লেখা লিখে ফেলেছেন যে আর না লিখলেও চলবে। এখন সংকলন করে তার মধ্য নিজের ৯টি করে কবিতা ঢুকিয়ে দিলেই তেলেসমাতি শেষ, অমরত্ব ঠেকায় কে? চমৎকার, ধরা যাক দু’একটা ইদুঁর এবার! এইসব স্বঘোষিত মহান কবিদের কবিতার গন্ধ নিলে আবার ওপার বাংলার কিছু কবিদের গন্ধ শুধুই নাকে এসে লাগে, এই যেমন- বিনয় মজুমদার, উৎপল কুমার বসু, রনজিৎ দাশ, জয় গোস্বামী প্রমুখ। স্বঘোষিত মহানেরা যেখানে নিজেদের কাব্য ভাষাই খুজেঁ পাননি, সেখানে কবিতার দায় কিভাবে মেটাবেন? আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে, এ সময়ের কবিদের মধ্যে সিকি, আধুলি খুজেঁ পাওয়া যায়, একটা পুরো টাকা খুজেঁ পাওয়া যায় না। এতো অল্প কাজ দিয়ে কাব্য সাহিত্যের বাকবদল করবেন? আশির হাতে গোণা দু’একজন কবি নিয়মিত লিখে চলেছেনএবং যদি চর্চা করে যান, তাহলে তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ টাকা হয়ে উঠতে পারেন, আশা করি। সেই দিক থেকে দেখলে, নব্বইয়ের কবি এবং তাদের সৃষ্টির পরিমাণ অনেক অনেক বেশি এবং বিচিত্রময়। অধিকাংশ কবি সমানে লিখে চলেছেন। কিন্তু সাজ্জাদ শরীফ তাদের ভিতর থেকে খুব কম কবিকেই নিয়েছেন। এবং প্রধান সেইসব কবি যাদের নেননি, তিনি নিজে কি তাদের ধারে কাছে আসতে পারবেন? নাম করে আর কি হবে, ইতিমধ্যে অনক নাম আলোচকেরা উল্লেখ করছেন।

সুমন রহমান তার লেখায় সাজ্জাদ শরীফের সাথে প্রধান বিষয়ে কোনো দ্বিমত পোষণ করেন না। তিনিও সাজ্জাদ শরীফের মতো মনে করেন যে, আশি-পূর্ব কবিতা’অকবিতার কাল’ এবং আশি-পরবর্তী কবিতা’ কবিতার শুরুর’ কাল। তার যতো আপত্তি তা হল, সাজ্জাদ শরীফ বিভাজিত এই দুই কালপর্বের কবিদের সংখ্যা নিয়ে। সুমন রহমান তার ‘ইনক্লুসিভ’ এবং ‘এক্সক্লুসিভ’ থিওরী প্রয়োগ করে বলতে চেয়েছেন যে, সাজ্জাদ শরীফ আশি-পূর্ব যতো কবিদের ইনক্লুড করেছেন, এতো না করাই উচিৎ ছিল, কারণ তারাতো ইতিহাসের দায় মেটানো কবি, প্রকৃত কবি নন। বরং ‘এক্সক্লুসিভ’ নীতি পরিহার করে সাজ্জাদ শরীফ যদি আশি পরবর্তী কবিদের থেকে আরো কিছু কবিদের ইনক্লুড করতেন, তাহলে এই ঝামেলা থাকত না। আমি কিন্তু সুমন রহমানের এই ধারণার সাথেও একমত হতে পালাম না। আমি মনে করি আশি-পূর্ব এবং আশি-পরবর্তি, উভয় ক্ষেত্রে, সাজ্জাদ শরীফ এক্সক্লুসিভ নীতি প্রয়োগ করেছেন। তা না হলে, তিনি কিভাবে সিকান্দার আবু জাফর, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, হেলাল হাফিজ, দেলওয়ারের মতো কবিদের বাদ দেন ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং আনোয়ার পাশার মতো অকবিদের ইনক্লুড করেন? আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি, বাঙালীর নৃ-জাতিস্বত্তা অণ্বেষণের কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা ইতিহাসের দায় একটু বেশি মিটিয়েছেন বলেই কি সাজ্জাদ শরীফের এতো রাগ?

সাজ্জাদ শরীফের এই সংকলন শুধুমাত্র দলবাজি এবং গোষ্ঠীবাজির নমুণা, নাকি তার থেকেও কোনো গভীর উদ্দেশ্য ও রাজনীতি রয়েছে, তা ভেবে দেখার জন্য বঙ্গের কবিকুলকে আহবান জানাই। ধন্যবাদ।

Shumon Rahmaner noter Link : http://www.facebook.com/home.php?#/note.php?note_id=60496773121&ref=mf

Mujib Mehdy'r noter link : http://www.facebook.com/note.phpsaved&&suggest¬e_id=173109440124#/note.php?note_id=76113929687&id=520648687&ref=share

সংযোজনঃ অগ্নি ও আংগিক

কবিতার অতি রাজনীতিকরণ বা তার অশৈল্পিক ব্যবহার বাংলাদেশের কবিতার জন্য যেমন কখনো কখনো ক্ষতির কারন হয়েছে, তেমনি বিরাজনীতিকরনের ধারণা তার থেকে আরো বেশী ক্ষতির কারণ হবে, সন্দেহ নেই।বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা রাজনীতি এবং সমাজ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে পারব না। এরপরেই একটি প্রশ্ন সংগতভাবে এসে হাজির হবে, আমরা তাহলে রাজনীতি ও ইতিহাসের দায় মিটিয়ে কবিতার নান্দনিক দাবী মেটাতে পারব তো? আমাদেরকে কি তবে পুনরাবৃত্তিমূলক রাজনীতি ও ইতিহাসের মতই কাব্যভাষার পুনরাবৃত্তি করতে হবে?মানে, আমরা কি তাহলে শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুন, শহীদ কাদরী, আবুল হাসান অথবা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লার ভাষাতেই কবিতা লিখব? উত্তর- না!এটা প্রতিটি যুগের কবিদের দায়িত্ব যে, দেশ সমাজ ও বাস্তবতাকে আত্মস্থ করেই কাব্যভাষা ও আংগিককে অগ্রসর (update) করে নেয়া যা অগ্নি ও আংগিককে একইসংগে ধারণ করবে। এখানেই তো প্রকৃত কবির চ্যালেঞ্জ ও তার সৃজনশীলতার প্রমান। সাজ্জাদ শরীফ ও রনজিৎ দাশ যেভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, আশিতে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বংগের কবিতা শুদ্ধ পশ্চিমি আধুনিকতার পথে সমান্তরালে চলেছে, তা যে ভ্রান্ত সে ব্যাপারে পূর্ববর্তী আলোচকেরা দৃষ্টিপাত করেছেন।

শামসুর রাহমানের প্রথম পর্বের কবিতা, সিকদার আমিনুল হক এবং আবদুল মান্নান সৈয়দের সমগ্র জীবনের কবিতা যে পশ্চিমি আধুনিকতার মুগ্ধ অনুসারী সে কথা কারো অবিদিত নয়। বরং শামসুর রাহমানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কবিরা পশ্চিমি আধুনিকতাকে গ্রহন করেছিলেন পাকিস্তানি ভাবাদর্শে লালিত সাম্প্রদায়িক মনোজগতের বিপরীতে অগ্রসর সমাজ ভাবনায় এবং তা ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত বাংগালী জাতিসত্তা ও তার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্নের ভেতর সঞ্চারিত করে নতুন আধুনিকতার জন্ম দিতে। ফলে পশ্চিমি আধুনিকতা ও স্বাদেশিকতার যৌথতায় যে নতুন আধুনিকতার জন্ম হল, সেটাই বাংলাদেশের কবিতার আধুনিকতা।কিন্তু সেখানেও পশ্চিমি আধুনিকতার যে অবশেষ রয়ে গেল, তা থেকে সচেতন উত্তরনের আকাংখাই নব্বইয়ের কবিতার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। পৃথিবী জুড়েই উত্তর-ঔপনিবেশিক যেসব ডিসকোর্স ৬০-উত্তর কালপর্বে বিভিন্ন তত্ত্ব ও চিন্তার আকারে হাজির হ’ল, তার থেকে ৯০-র অনেক কবিই আলো নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। স্বদেশ, ঐতিহ্য এবং মাটি-ঘনিষ্ঠ কাব্যভাষা অন্বষনের তাগিদ এপর্বের অধিকাংশ কবিদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, যা কলাকৈবল্যবাদী পশ্চিমি আধুনিকতার ধবজাধারী কবিদের থেকে যোজন দূরত্বে অবস্থান করে। কিন্তু রাজনীতি বিমূখীনতার কারনে অথবা রাজনীতি ও শিল্পের যে মরমীয়া সম্পর্ক তা অনুধাবনের অভাব এইসব ঐতিহ্য অন্বেষী কবিদের অনেককেই পরিনামদর্শী কাব্যভাষা অর্জনে বঞ্চিত করে রেখেছে।রাজনৈতিক সচেতনতা কাব্যদেহে প্রবাহিত রক্তসঞ্চালনের মত যা দৃষ্টিগোচর নয়, কিন্তু যার অভাবে জীবিত মানুষকে ফ্যাকাশে দেখায়। নব্বইয়ে এমন কবিরাও রয়েছেন, যারা উপরোক্ত শর্তাবলী পূরণ করে দৃষ্টিগোচরভাবে উজ্জ্বল, স্বতন্ত্র ও স্বাধীন, কিন্তু মিডিয়ার আলো তাদের উপর অতবেশী পড়ে না। প্রকৃত পাঠক তাদের কথা জানে এবং অনুসন্ধিৎসু পাঠক তাদের নিশ্চয়ই খুঁজে নেবে।

বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিঁচিঃ ‘রাধিকাপূরাণ’ নিয়ে যত ব্যাকরণ (কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ছন্দালোচনার উত্তরে



বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিঁচিঃ ‘রাধিকাপূরাণ’ নিয়ে যত ব্যাকরণ (কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের ছন্দালোচনার উত্তরে)

তুষার গায়েন
Share
Tuesday, June 2, 2009 at 3:17pm
কবি শাহানা আকতার মহুয়ার একটি ছোট্ট কবিতা ‘রাধিকাপূরাণ’ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়ে গেল। যেন ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিঁচি’, এইরকম দশা!এই আলোচনা আর প্রলম্বিত করার করার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু আমি নাচার। আলোচনা উঠলে তাকে তো একটা যৌক্তিক পর্যায়ে এনে শেষ করতে হবে! এক্ষেত্রে কারো কটূ-কাটব্য, শ্লেষ ও ব্যক্তিগত আক্রমন গ্রহনযোগ্য নয়। যে-কোনো বিষয় নিয়েই আলোচনার পথ খুলতে পারে, শুধু তাকে সুস্থতার মধ্যে ধরে রাখতে হবে, এটাই হোক অঙ্গীকার।

সুব্রতদা বলেছেন যে “বাংলা ছন্দের কোনো ইউনিট যুক্তাক্ষর বা অযুক্তাক্ষর না, বরং রুদ্ধ এবং মুক্ত অক্ষর (Syllable)”। তিনি কি ‘মুক্ত-অক্ষর’ ও ‘রুদ্ধ-অক্ষর’ বলতে ‘মুক্ত সিলেবল্’ (Open syllable) ও ‘রুদ্ধ সিলেব্ল্’ বুঝিয়েছেন? কারণ এর ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি যে উদাহরণ টেনেছেন, তা হচ্ছে সিলেব্লের ধারণা। কিন্তু ‘মুক্ত-অক্ষর’ ও ‘রুদ্ধ-অক্ষর’বলতে কি কিছু হয়, না তা হয় ‘মুক্ত সিলেবল্’ও ‘রুদ্ধ সিলেবল্’-র বাংলা প্রতিশব্দ? সিলেব্লের বাংলা প্রতিশব্দ কি? কবি ও ছান্দসিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’-এ (ছন্দের সরল পাঠ হিসেবে যে বইয়ের কোনো জুড়ি নেই)বলেছেনঃ “সিলেব্ল্-এর বাংলা প্রতিশব্দ কী করব? সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত করেছিলেন ‘শব্দ-পাপড়ি’; কালিদাশ রায় করেছেন ‘পদাংশ’; প্রবোধচন্দ্র দল’এর পক্ষপাতী। অনুমান করতে পারি, সত্যেন্দ্রনাথ ও প্রবোধচন্দ্র শব্দকে পুষ্প হিসেবে দেখেছেন; সিলেব্ল্ তার পাপড়ি কিংবা দল। ... এক কথায় বলতে পারি, কোনও-কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে নূন্যতম চেষ্টায় যেটুকু আমরা বলতে পারি, তাই হচ্ছে সিলেবল। সেই দিক থেকে এক-একটি সিলেব্ল্ হচ্ছে আমাদের উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট কিংবা একক।... ধরা যাক, ‘কবিকঙ্কণ’ শব্দটাকে আমরা উচ্চারণ করতে চাই।... ক+বি+কং+কণ্, অর্থাৎ শব্দটি মোট চারটি সিলেবল্-এর সমবায়ে গড়ে উঠেছে।’’ (কবিতার ক্লাস, পৃষ্ঠা৭৮)

এর ভেতর প্রথম দুটো মুক্ত সিলেবল্ ও শেষের দুটো রুদ্ধ সিলেবল্। দেখাই যাচ্ছে যে, সিলেবল্ যেহেতু এক বা একাধিক অক্ষরের সমবায়, তাই মুক্ত ও রুদ্ধ-অক্ষর বললে এর চারিত্র্য প্রকাশ পায় না। কেননা, ‘রুদ্ধ-অক্ষর’ তো যে-কোনো একটি অক্ষর নয়, বরং অক্ষর-সমবায় (শব্দ-পাপড়ি/ পদাংশ/দল)।

সবাই অবগত আছেন যে, বাংলা কবিতার প্রধান তিনটি ছন্দঃ অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত।ছন্দ বোঝার ক্ষেত্রে রীতিসিদ্ধ ব্যাকরণের পথ ও পরিভাষার ব্যবহার নবীন কবি, সাহিত্যের ছাত্র ও সাধারণ পাঠকের জন্য আনন্দের পরিবর্তে সচরাচর বিরাগের কারণ হয় বলে, নীরেন্দ্রনাথ এর সরল বিকল্প হিসেবে প্রথম দুটি ছন্দ অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে, অক্ষর ও যুক্তাক্ষরকে মাত্রা গণনার একক (unit) হিসেবে উপস্থাপন করেন।পাশাপাশি এর সীমাবদ্ধতা এবং ধ্বনির সঙ্গে অক্ষরের স্পর্শকাতর সম্পর্ক নিয়েও সচেতন থাকার কথা বলেন। উদ্ধৃতিঃ “ধ্বনিটাই অবশ্য প্রধান কথা, অক্ষর নেহাতই গৌন ব্যাপার। ... তবু, প্রথম দুটি ছন্দের ক্ষেত্রে অক্ষরও একেবারে ন-গণ্য নয়। ব্যতিক্রমের কথা যদি ছেড়ে দিই, তবে অক্ষরের ভিত্তিতেও মাত্রার একটা মোটামুটি হিসেব সেখানে রাখা চলে। স্বরবৃত্তে সেটা একেবারেই চলে না। একই শব্দ যে এই তিন রকমের ছন্দে কীভাবে তিন-রকমের মাত্রামূল্য পায়, কবিকঙ্কনের ‘কঙ্কণ’ দিয়েই সেটা বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

(১) অক্ষরবৃত্তে সাধারণত প্রতিটি অক্ষরই একটি করে মাত্রার মূল্য পায়। সুতরাং ‘কঙ্কণ’ সেখানে ৩-মাত্রার শব্দ।
(২) মাত্রাবৃত্তে আমরা সাধারণত প্রতিটি অক্ষরকে একটি করে মাত্রার মূল্য দিই, কিন্তু শব্দের মধ্যস্থ কিংবা প্রান্তবর্তী যুক্তাক্ষরকে (যদি না সেই যুক্তাক্ষরের ঠিক পূর্ববর্তী বর্ণটি হসবর্ণ) দিই ২-মাত্রার মূল্য। সুতরাং ‘কঙ্কণ’ সেখানে ৪-মাত্রার শব্দ।
(৩) স্বরবৃত্তে আমরা প্রতিটি সিলেবল্কে একটি করে মাত্রার মূল্য দিই, এবং ‘কঙ্কণ’ শব্দটিতে মোট দুটি সিলেব্ল্ (কং+কণ্) পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং ‘কঙ্কণ’ সেখানে ২-মাত্রার শব্দ। (কবিতার ক্লাস, পৃষ্ঠা ৮০)

ছন্দ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথও‘যুক্তাক্ষর’ নামক শব্দবিধি ব্যবহার করেছেন, যার উল্লেখ নীরেন্দ্রনাথ তাঁর এ বইয়েই করেছেন।... ‘মানসীর’ ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার রচনার এই পর্বেই যুক্ত অক্ষরকে পূর্ণমূল্য দিয়ে ছন্দকে নূতন শক্তি দিতে পেরেছি।’’ (কবিতার ক্লাস, পৃষ্ঠা ৫৮)

বাংলা যে-কোনো ছন্দ বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে, শেষ বিচারে সিলেবল্ই মোক্ষম ও ব্যাকরণসিদ্ধ, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, এবং নীরেন্দ্রনাথ তা করে দেখিয়েছেন তাঁর এ বইয়ে (সব ছন্দই কি সিলেবিক, পৃষ্ঠা ৯৪)। কিন্তু অন্যথাও যে হতে পারে উপরের আলোচনা তারই উদাহরণ।

সুব্রতদা সিলেব্ল্-এর ব্যাখা দিতে গিয়ে ‘সাধারণ নিয়ম’ বলতে কী বুঝাতে চেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়। ‘সাধারণ নিয়ম’ বলতে যা বুঝিয়েছেন তা হচ্ছে মাত্রাবৃত্তের হিসাব।

অত্যন্ত = অত্(রুদ্ধ সিলেব্ল্)তন্(রুদ্ধ সিলেব্ল্)তো(মুক্ত সিলেব্ল্) = ২+২+১= ৫

এটা শুধু অক্ষরবৃত্তেই নয়, স্বরবৃত্তেও হবে ৩ মাত্রা। স্বরবৃত্তে যে-কোন সিলেব্ল্ই, রুদ্ধ কী মুক্ত, এক মাত্রার মূল্য পায়। যাই হোক, সিলেব্ল্ ব্যবহার করে যদি ‘রাধিকাপূরান’-এর বহুল আলোচিত ‘কৃষ্ণের উষ্ণ বুকে’ বিশ্লেষন করি, তাহলে অক্ষরবৃত্তের নিয়মে দাঁড়াবেঃ

কৃষ্ণের= কৃষ্(রুদ্ধ সিলেব্ল্)+ নের্(রুদ্ধ সিলেব্ল্)= ১+২= ৩ মাত্রা

উষ্ণ= উষ্(রুদ্ধ সিলেব্ল্)+ নো(মুক্ত সিলেব্ল্)= ১+১ = ২ মাত্রা

‘উৎসুক’ শব্দকে এভাবে বিশ্লেষন করে দেখানো যেতে পারে যে, তা-ও কোনভাবেই তিন মাত্রার বেশী নয়।

আমি বুঝি না, এক্ষেত্রে ছন্দ-দক্ষ ও ছন্দ-অদক্ষ কবির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন লাইসেন্স কিভাবে প্রযোজ্য হতে পারে?

মূল নোটটি পড়তে নিচের লিঙ্ক ক্লিক করুনঃ

http://www.facebook.com/profile.php?id=1482225454#/note.php?note_id=80303980417&ref=mf

শীতে লেখা ডায়াস্পোরা


শীতে লেখা ডায়াস্পোরা


রাত্রি-ঝরোকা

আজ রাত কোটি কোটি বরফের ধূ ধূ কণা
ব্যাপ্ত কালো অন্ধতার গায়ে আদন্ত নখ
শ্বেত ভল্লুকের থাবা

বাতাস সংঘর্ষে কাটে
চূড়ান্ত নৈরাজ্যে
বিভক্ত জাতির আত্মঘাতী কলহের মত
পরস্পর এলোমেলো
উল্লম্ব ও আনুভূমে

আ ... আর্ত চিৎকার
পাতাহীন নিঃস্ব কালো, নিঃসঙ্গ গাছের ডালপালা
ভীত ত্রস্ত জড়িয়ে পেঁচিয়ে সাঁই সাঁই বাতাসের
বেগ থেকে কোনোমতে বেঁচে যেতে চায়

ধারা ... ধারাপাত বরফের
নৃত্যরতা সাদা মেয়ে পোষাকে স্বাধীন
অনুপম কোমর ভঙ্গিমা
জ্বলে অগ্নি নিম্ন নাভিদেশে
পদতলে ভাঙে বরফের কাঁচ
জমে জমে জমাট বরফ এই
জ্বলজ্বলে মাটির উপরে
ধারাল নক্ষত্রমালা ...

আমি যাই বলো জল, কিভাবে গহন ঠেলে ঠেলে
বর্ণহীন নিরাকার এতদিন জেনেছি তোমাকে,
আজ অবধূত সাদারূপে সয়লাব পথে ও প্রান্তরে
ঝিকমিক হাসো সাদা দাঁতে

তাতে যে আমার দূরত্ব বাড়ে
এই রাত প্রোষিতভর্তৃকার মত
দূরে এক নিঃসঙ্গ শয্যা পড়ে আছে ...


নিশিঘর

এত যে বরফ বালি উড়ে উড়ে এসে পড়ে
জমে জমে আলোকিত সাদা আয়তন
প্লাবিত জমাট ঢেউ আলো আঁধারিতে
মসৃণ গম্ভীর ভাঙে পায়ের আওয়াজে মচ্ মচ্

তার চেয়ে এসো গড়ি বরফের ঘর
দু’হাতে সরিয়ে ফেলে রাশি রাশি
তুষার ঘনক থেকে শূণ্যতা বের করে আনি
সারি সারি বরফ স্তম্ভের পরে ছাদ, শুয়ে থাক প্রবল জমাট
অস্বচ্ছ মেঝের মোজাইক, জানালায় স্বচ্ছ আবরণ
চেয়ার টেবিল ঠিক ঠাক -- বরফে নিপূন কারূকাজ
ভেতরে একটু ঘুরে পানশালা, লালমদ, যোনির প্রদীপ।

সূর্যরাগ

সে কেমন ঘর আমি বানিয়েছি জলের প্রাচীরে
উগ্রপন্থী বাতাস এসে ঝাঁকে ঝাঁকে ছিদ্র করে ফেলে
হিমরাত যদি কাটে কোনোমতে চাঁদের আলোয়
সকালের সূর্য এসে প্রখর ধমকে
স্ফটিক স্থাপত্য নেয় দ্রুত গলনাঙ্কে টেনে
বলে, তিনরুপে বিরাজিত তুমি
তোমার স্থিতি নেই কোনো
নিশ্চল হয়ো না তুমি কখনও কোনো প্রেমে
উৎসারণ সত্য শুধু জেনো, যুগ যুগ, আকার ও বর্ণগতভেদে !

টরন্টো, ফেব্রুয়ারী ২০০৯

তুষার গায়েন

কবি তুষার গায়েনের কবিতা : উত্তর মালঞ্চ এবং অন্যান্য


উত্তরমালঞ্চ

বনপ্রস্থান

মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী

থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে

বাঘমামা, যদি না থাকিতে বনে…এইবার যাই!
পালাই পালাই বন থেকে দূরে লোকালয়, বিদ্যালয়
প্রথম পাঠের ঘণ্টাধ্বনি, হ্রেষা শোনা যায়…


স্মৃতি: বনে বাড়ে রাজার কুমার

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর

বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে!


রাজটিকা

কোটালকন্যার হাতে যদি বাড়ে রাজার কুমার
তবু সে’তো রাজপুত্র, রাজধর্ম তাঁর
একযুগ পার হলে যেন সব চিহ্ণ
সমান স্বরূপে ফুটে ওঠে তাঁর, এই ভার
নিয়েছি নিজের বোধে…কেউ জানে নাই
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!



পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি

মৃতের শরীর থেকে মৃত্যু উড়ে গেছে
জীবন চিৎকার করে নামে সেইরাত
চোখের কোটরে দেখি আবার চোখের জল
ধুয়ে যায় দৃশ্যগাঁথা বন সর্ সর্
বিদেহী ছায়ারা দ্রুত মিশে যায় বাষ্পীভূত
আকাশে আকাশময় জড়ো হয় মেঘ
বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা ধারা হয়ে নেমে আসে
ন’ড়ে চ’ড়ে কচুপাতা কিছু জল ধরে রেখে
বাকিটুকু ফেলে দেয় পতনের প্রেমে:
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে…
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।


ধল প্রহরের গান

ওঠো ওঠো রাজার কুমার বিদ্যালয়ে যাও
বিদ্যালয়ে তোমার সমান রাজকন্যা পাও
দূধের বরণ রাজকন্যা শ্বেতপঙ্খী নায়ে
এনে দেবো পঙ্খীরাজ চিঁহিঁ রবে গায়
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে!


দাঁতে কাটি কারাগার

দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
‘বাঘমামা, খেয়ো না খেয়ো না, এই কাঞ্চী কুমারের নিধি
এত সাধ রক্তপানে যদি, তবে খাও আমাকেই আগে’…
একে একে দাঁতের বিনাশে কাটে শিকলের ভার
কাক ডাকে ভোর হয় ফর্সা আকাশে
নিথর একটি, তবু, দু’টি তারা থাকে!



বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল

দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট

কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস

আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…

রাজা আমায় নিলেন নাকো ঘরে, না দিলেন মৃত্যুপরোয়ানা!

তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।



২.
বাউল গাইতে পারি যেন

ঠাকুর্মা গল্পের মত কথা বলে যেন এক পৌরাণিক পাখি
গেয়ে ওঠে গান, কণ্ঠে সোনালী তরঙ্গ তার পাকা ধান হয়ে ঝরে
ঠাকর্মা ধানের কথা বলে- কতদিন বলেছে এমন!
ধানগুলো ধীরে ধীরে আঁধারের গায়ে সাদা খই হয়ে ফুটে গেছে
স্বপ্নের মতোন ঝ’রে গেছে তারপর ঠোটেঁ তার সাদা খই
ঠাকর্মা হাঁসের গল্প করে- খইরঙা রাজহাঁস মুক্তোর মতোন সাদা
ডিম দিত নাকি পুকুরের সবুজ শৈবালে, হাঁসগুলো কোমল মেঘের মত
উড়ে গেছে কবে, মেঘ হয়ে ঝরে এখনও- ঠাকুর্মা মেঘের কথা বলে
সাদা কালো মেঘে নাকি হয় সখা মিলন গভীর!

মেঘের মিলন গাঢ়- মোটাবৃষ্টি, ঋজুরোদ সব
ঝরেছে অনেক তার, ছেনেছে অনেক আর মরমের মাটি তার
ভিজেছে অনেক বহু বাসনা মনের তাই হলুদ শর্ষের ক্ষেত ধূ ধূ
প্রগাঢ় সবুজ ধান; শান্ত গাভী, শিশু তালগাছ- নিমছায়া
খালে জল বয়ে গেছে ধারাল প্রখর গেছে বয়ে লোনাজল
সারি সারি শুপুরীর শেকড় ছুঁয়েই, সীমিত ডোবার সাথে মিশে একাকার
সেইখানে কালো কই, সতেজ মাগুর মাছ করে গৃহবাস
তেলের তাপিত ঘ্রাণে মৌ মৌ উঠে গেছে ঠাকুর্দার স্বাদু ঠোঁটে
ঠোঁটে তার ঝরে শুধু ভোজনের স্মৃতি :

ভোজন উৎসব হবে তাই, ছায়ারাত- ছায়ার আঙ্গিকে গাছ
পাতায় পাতায় মিহি নকশার ছাপ সুগন্ধী উঠোন জুড়ে ফুটে ওঠে
পুন্নিমা আলোয়, ডাকে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, পিঠার শরীরে কারুকাজ-
নারীর কোমল হাত, ঘিয়ের প্রদীপ শত কাঁসার বাসন আর অনেক মানুষ
ঠাকুর্দা আহ্লাদে বলে, কই মাছের মাথার মধ্যে থাকে বারোতীর্থের জল, ওগো!
বৌমা, পাতের ওপর ওই মাথাটা দিলে না কেন, দাঁত না হয় গেছেই ঝরে।

এখন ভোজন বেশি নেই আর তাই ঠাকুর্দা বৃথাই অত ভোজনের কথা বলে।
বাসনা এখন বেশি বেঁচে নেই আর ঠাকুর্মা কেবলি বাসনার বার্তা দেয়।

বাসনার শেষকৃত্য হয়ে গেছে শেষ!
তবে এই সাধ কেন, এইসব ছবি কেন?
ছবি সব যায় নাতো চেনা, স্মৃতি তার যতই থাকুক…
পিতার নীরব কণ্ঠে এইসব কথা ঝরে পড়ে, যেন চিটাধান ঝরে
পিতার নীরব কণ্ঠে চিটাধান ঝরে। ঝরে কেন?

পিতা নিরুত্তর- শুধু হেঁটে যায় ধীরে কোদালটা নিয়ে কাঁধে
মাঠের এ আল থেকে ও-আল, ও-আল থেকে দূরে, ও..ই দূরে
পথের কিনারে তালগাছ, নিথর দুপুররোদে হেঁটে যায়
কোনো গাঁয়ে গঞ্জে নেয় তাকে কিনে কেউ সারাটা দুপুর ভর


পিতার নীরব কণ্ঠে তাই শুধু চিটাধান ঝরে।

আচমকা একজন তরুণ বাউল রুদ্রপায়ে উড়ে আসে যেন, কণ্ঠে তার
মেঘের গর্জন বেজে ওঠে তুমুল ঝংকারে, গেয়ে যায় অগ্নিঝরা অবিরাম
জ্বলে যায় বাসনার শব, জ্বলে যায় বিগত বিলাস- ক্লান্ত হতাশ্বাস জ্বলে যায়…
একবার জ্বলে গেলে নেভে না কখানো তাই, ফুটে ওঠে লালফুল বাউলের হাতে।

আমি তবে গাইব বাউল!

সুধীজন, এই আশিস দেবেন মোরে
বাউল গাইতে পারি যেন মোর সারাটা জনম জুড়ে!!


৩.
ক. যে রূপ আমি শুনিলাম কানে

যে রূপ আমি শুনিলাম কানে
মালিনী মাসির হাসি, নিলাজ গুঞ্জন তুলে আনে
আনন্দিত শিহরণ এই ভীত মনে- সরোবরে
ছায়া প'ড়ে আছে তার এ অমোচনীয় আঠার প্রলেপ
বায়ুযোগে ঢেউ ওঠে গোল হয়ে, সরে যায় দূর
গোলাকার তলে-তবু রূপ তার হাসিতে অনড়
বেড়ালের মতো এই অপরাহ্ণ বেলা!

নিবিড় নৈঃশব্দ চারিদিকে, ফুল ফোটাবার যত
আয়োজন গাঢ় প্ররোচনা করে যায় ঝিঁঝিঁদের
দল, জোনাকিও জোটে এসে- জ্বলে নেভে ঈর্ষাতুর
দূর তারাদের দেখে। যে গেছে চন্দনবনে-

মাসি তার চোখ বেঁধে রাখো কেন?
সুরভি কি ঢেকে রাখা যায় বলো, আঁচলের তলে?
সখির কাঞ্চনরূপ কালির কলঙ্কে বুঝি মোছে!
হয়েছে হয়েছে মাসি, তাঁকে দূর থেকে ভালবাসি
দেখি নাই যাকে কোনদিন, তবু তাঁর রূপের কীর্তন
আমি শুনেছি তো কানে!


খ. যে রূপ আমি শুনিলাম কানে

যে রূপ আমি শুনিলাম কানে, আজ
দেখি তোমাকেই সেই থকথকে গলিত কাদায়
নিঠুর কুষ্ঠের ক্ষতে -তোমার দেহের জরা যদি
কাটে চুমুর সন্তাপে, দেবো তাই প্রাণভরে আমি
দেখে নিই আগে সেই বিলুপ্ত রূপ
গলিত অঙ্গে যার ছায়া পড়ে আছে...

আমার চুমুর রঙে তুমি ফিরে পাবে ফের
সোনার যৌবন, আমি হবো গাছ বিপরীতভাবে
তোমাকে দেখার সাধ যুগ যুগ ধরে
পাতা মেলে চেয়ে রবো- দেখিতে তো পাবো
আমি তারে, যারে দেখি নাই কোনদিন
মানবীর অধিকারে...ওই সরোবর-পাড়ে
দূর কদলীছায়ায় রূপের তরঙ্গ
যদি ছুঁড়েছিলে হায়, কেন ডাকো নাই
ফুল হয়ে ফুটিতেছিলাম আমিও তো
স্নিগ্ধ কামিনীর ঘ্রাণে!

ফরহাদ মুস্তাফার নোট : কবিতার কলকব্জা : কবি তুষার গায়েনের কবিতা ‘উত্তরমালঞ্চ’: তার রূপজগতের রূপকথা-চূপকথা


ফরহাদ মুস্তাফার নোট : কবিতার কলকব্জা : কবি তুষার গায়েনের কবিতা ‘উত্তরমালঞ্চ’: তার রূপজগতের রূপকথা-চূপকথা

(*উত্তরমালঞ্চ কবিতাটি আলোচনার নীচে দেওয়া হয়েছে)
‘রূপকথার সৌন্দর্য সম্ভার তাহার জন্য, যে পৃথিবীর সংকীর্ণ আয়তনের মাঝে নিজ আশা ও কল্পনাকে সীমাবদ্ধ করে নাই’।– শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
১.
ঠাকুরদাদার ঝুলির রূপকথা ছেলেবেলায় পড়েছি। এর মধ্যে ‘মালঞ্চমালা’ কাহিনীটি অন্যরকম। যখন দাদাজানের কাছে শুনেছি, অবাক ঘুরে বেড়িয়েছি রূপের জগতে। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যেত। ঘুমের মধ্যে দেখতাম- একটি মেয়ে বনে বনে ঘুরছে, কোলে তার শিশু। তার সঙ্গে কথা বলে বাঘ, বনের পাখি, গাছপালা, নদী-নালা। আরেকটু বড়ো হয়ে শুনেছি, রূপবান যাত্রাপালাটি। মালঞ্চমালারই কাহিনী। শেষদিকে একটু বদলে দেওয়া। চরিত্রগুলোর নাম ভিন্ন, কিন্তু সুর অভিন্ন। অভিন্ন বলেই হিন্দু-মুসলমান এই কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মধ্যে নিজস্ব আত্মার ধ্বনি চিনতে পেরেছে। উভয়ের নিজস্ব সম্পদ হয়ে উঠেছে । এই পালাটির গানগুলির মধ্যে একটি সতীনারীর সমগ্র জীবনের চোখের জলে ভাসানো জীবন-সংগ্রাম যে করুণ আবেদন সৃষ্টি করে, মনে হয়, এই কান্না বাতাসের, ঐ আকাশের, প্রকৃতি আর অখণ্ড সত্তার। খণ্ড খণ্ড হয়ে যে সত্তাটি জীবনের প্রতি বাঁকে বাঁকে কেঁদে ফেরে-‘আমার মিলন লাগি আসছ তুমি কবে’- অখণ্ডের সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার আকাঙ্খারই আর্তি এই সব।

২.
গল্পটির দিকে একটু ফেরা যাক। এক রাজার পুত্র-সন্তান হলে রাজজ্যোতিষী বললেন, এর আয়ূ মাত্র ১২ দিন। তাকে বাঁচাতে হলে ১২ বছরের কন্যার সাথে বিয়ে দিতে হবে। রাজা খুঁজে পেলেন- কোটাল কন্যা মালঞ্চমালা। মালঞ্চর বয়স বারো। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত মালঞ্চর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হল ১২ দিনের শিশু রাজপুত্রের এবং বিয়ের রাতেই শিশুটি মারা গেল। কিন্তু গল্পটি মারা যায় নাই। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন ও শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ী করলেন নিষ্পাপ মেয়েটিকে। বললেন, মেয়েটি ডাইনি, ওকে আগুনে পোড়াও। মৃত রাজপুত্রের সঙ্গে মালঞ্চমালাকেও চিতায় তোলা হল। আগুন জ্বলে উঠল।
বৃষ্টি এসে নিভিয়ে দিল সে আগুন। বেঁচে গেল মেয়েটি সতীদাহ থেকে। প্রকৃতি ঘোষণা করল মেয়েটি ডাইনি নয়, সতী নারী। সতী নারীর কোলে শিশু স্বামী- মৃত রাজকুমার। রাতে ভূত-প্রেত এসে মৃতদেহটিকে খেতে চায়। মালঞ্চমালা তাকে আগলে রাখে, ভুতপ্রেত ফিরে যায়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই মালঞ্চমালা শিশু স্বামীটির প্রাণ ফিরে পায়। এইখানে গল্পটি শেষ হলে ভাল হত। কিন্তু রূপের কথা শেষ হয় না। রাতে ভূত- দিনে বাঘ। কে বলে তাদের ভাগ।
বনের বাঘ এসে কচি শিশুটিকে খেতে চাইল। মালঞ্চমালার ব্যবহারে বাঘ মুগ্ধ হয়, বশ মানে। তারা আর ব্যাঘ্র নয়- হয়ে ওঠে বাঘ মামা, বাঘ মামী। কোনো মানুষ নয়- বাঘই এই একাকিনী মেয়েটির আত্মীয়-বান্ধব হয়ে ওঠে। বনের গভীরে বাসা বানায় মেয়েটি। দুধ আর মধু জোগাড় করে আনে এই বাঘ মামা-মামী।
রাজপুত্র বড়ো হলে বিদ্যালয়ে পাঠাল তাকে মালঞ্চমালা। সেখানে রাজপুত্রের সঙ্গে পরিচয় হল ভিন দেশী রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে। গড়ে ওঠে প্রেম। এর পর অনেক ঘটনা। একটু সংক্ষেপে বলি।

রাজপুত্রের বাবা মালঞ্চমালার শ্বশুর বিপদে পড়ে বনে এলো। তখন জীবন বাঁচায় মালঞ্চমালা। রাজা মালঞ্চমালাকে চিনতে পারে। জানতে পারে তার পুত্র জীবিত। রাজপুত্রকে নিয়ে রাজা ফিরে যায় রাজ্যে। বনের মেয়ে বনে থাকে একা। কোটালকন্যা রাজার বাড়িতে যাওয়ার যোগ্য নয়। শাস্ত্র তাকে দিয়েছে নীচু জাত। বিয়ে হয় রাজকন্যা কাঞ্চির সঙ্গে রাজপুত্রের।
এরপর ভীন দেশের রাজা আক্রমণ করে রাজা ও রাজকুমারকে বন্দী করে। মালঞ্চমালা খবর পেয়ে বাঘবাহিনী নিয়ে তাদের উদ্ধার করে। নিজের দাঁত দিয়ে শিকল কেটে কেটে স্বামীকে মুক্ত করে। বাঘেরা মালঞ্চমালার প্রতি তার শ্বশুর শ্বাশুড়ীর অন্যায় অবজ্ঞা, অবহেলার কারণে খেতে চায়। মালঞ্চ তাদের বাঁচায়। রাজা কৃতজ্ঞতাস্বরুপ মালঞ্চমালাকে স্বীকার করে নেয়। রাজকন্যা কাঞ্চী হয় রানী, আর মালঞ্চমালা পাটরানী।
এইখানে মূল রূপকথাটির নটেগাছটি মুড়োলো। কিন্তু কবি তুষার গায়েনের ভাবের কথাটি ফুরায়নি।

৩.
তার আগে মূল কাহিনীর মালঞ্চমালাকে একটু ফিরে দেখা যাক। মালাঞ্চমালা নিম্নবর্ণের মেয়ে- কোটালকন্যা। শাস্ত্রমানা নারী। একটি মেয়ে যখন নারী হয়ে ওঠে – কারো স্ত্রী হয়ে ওঠে, তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারিত হয়- সতী নারী হয়ে ওঠা। তার নিজের জীবন বলে কিছু নেই। নিজের জীবন বিপন্ন করে তার স্বামী সংসারকে বাঁচাতে সবকিছু করে যায়।
এই কাহিনী সেই ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, পতি পরম দেবতা। স্বামী দেবতাটি যে রকমই হোক না কেন, তার সেবা করাই স্ত্রীর একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। নারীর কোনো ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্খা, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই। নারী এখানে কোনো ব্যক্তি নয়। নিতান্তই পুরুষের সেবিকা। এটাই তার জীবনের চরম সার্থকতা।

৪.
এই প্রচলিত ধারণাটিকে ভেঙ্গে দিয়েছেন কবি তুষার গায়েন তার বিনির্মিত উত্তর মালঞ্চ কবিতায়। তার কাছে মালঞ্চমালা রক্তমাংসের মানুষ। একই সঙ্গে তিনি নারী এবং ব্যক্তি। মালঞ্চমালার মানসিক দ্বন্দ্ব ও তার রক্তক্ষরণের ইতিহাস যেমন এই কবিতায় দেখি, তেমনি শ্রেণীবিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো কিভাবে প্রজাদের সঙ্গে আচরণ করত তার পরিচয় পাওয়া যায় এবং ঐতিহাসিকভাবে ভারত সমাজে কিভাবে জাতপাতের বিভক্তি শুরু হয়েছে তার উল্লেখও পাওয়া যায়। এটা একজন নারীর, ব্যক্তির, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোপরি আমাদের বাংলা তথা উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অনু-মহাকাব্য গাথা যা সমগ্রতা তৈরি করে, এক অখণ্ড বোধে উপনীত হতে সাহায্য করে।

৫.
‘রূপকথা আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন লোকসাহিত্যের ধারা, যাতে আমাদের দেশজ ও লোকজ ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ আমাদের মূল্যবোধ, দেশ ও জাতির অন্তরাত্মা এবং তার স্বরূপ: রূপকথার রাজকন্যা-রাজপুত্র ও রাক্ষস-খোক্কোসময় কাহিনীতে সম্পৃক্ত। এইসব ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পৃক্তিকরণ বর্তমান দিনের সাহিত্য সংস্কৃতির বড়ো লক্ষ্য।‘
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেছেন, রূপকথার নির্দিষ্ট কোনো রচনাকার নেই। তা জাতির অন্তরাত্মার প্রতিফলন। রূপকথাতে ব্যক্তি বিশেষের কোনো কথা নেই, সমগ্র জাতিরই প্রাণের কথা, অন্তরতম আশা-আকাঙ্খা এতে ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। মহাকাব্যের বিশালদেহে যেমন ব্যক্তি নিরপেক্ষ জাতির আত্মকথা বৃন্তহীন পুষ্পসম আপনাতে আপনি বিকশিত হয়ে ওঠে- রূপকথার রাজ্যেও সেই একই নিয়ম। কোথাও লেখকের নিজের এতটুকু কোনো ছাপ নেই। সর্বত্র একটা উদার বিশাল অনাসক্ত ভাবের লক্ষণ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
আধুনিক কবি এই ভাবটিকেই পাল্টে দিতে চান। ব্যক্তিহীনতার বদলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। মানুষের অধিকার, মর্যাদাবোধ এবং ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও গুরুত্বকে স্থাপিত করেন কথাবস্তুর মধ্যে। এইভাবে পাল্টে যায় রূপকথার জগৎটি আধুনিক কালের কবির কাছে। কথাবস্তু বলতে কোনো লেখার আক্ষরিক অর্থকে বোঝায়। আর এই লেখার মাধ্যমে যে অন্তর্নিহিত গভীর ভাবনার প্রতিফলন হয়, তাই হল ভাববস্তু। কালে কালে মানুষের বিচার বুদ্ধি পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে মানুষের মূল্যবোধ। তাই ভাববস্তুরও পরিবর্তন ঘটছে।
যেমন প্রাচীন মহাভারতে কর্ণ-কুন্তীর সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আধুনিক কালের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্ণ-কুন্তীর কথাবস্তু একই। তবে এদের ভাববস্তু আলাদা। মহাভারতে যুদ্ধপরায়ণতাই মূল। মহাভারতের কাহিনীতে কর্ণ-কুন্তীর যে সাক্ষাৎ হয় সেখানে মাতৃস্নেহ ও পুত্রস্নেহকাতরতার পরিবর্তে স্বার্থচিন্তা ও বীরত্ব প্রদর্শনের মেজাজটিই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথে- কুন্তীতে মাতৃস্নেহ আর কর্ণে সেই স্নেহ-বুভূক্ষতা বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে।
রামায়ণের মেঘনাদ পাপী ও কাপুরুষ। মাইকেলের মেঘনাদ একজন বীরযোদ্ধা- নির্ভীক-সাহসী।
আবার প্রয়োজনে কথাবস্তুও পাল্টে যায় আধুনিক কালে। কালকেতুর কাহিনীর ভাববস্তু অচল হয়নি- মানুষের দুঃখ-বেদনার নিয়তি এখন লেখা হচ্ছে গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে। কিন্তু মঙ্গলকাব্য আর লেখা হয় না।
সেই কথাবস্তু একেবারে বদলেছে। সেই প্রকাশ ভঙ্গিও একেবারে বদলেছে। যদিও সে তুলনায় ভাববস্তু বদলেছে কম।
বিষয়বস্তু আর রূপকলা – দুয়ে মিলে সাহিত্য একটি অখণ্ড সৃষ্টি হয়ে ওঠে। এই অখণ্ডতাই চিরন্তন। যামিনী রায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন- বড়ো শিল্পের মর্মকথা হল- চিরন্তনত্ব। শিল্পে এই চিরন্তনত্ব আছে তার বিষয়ে দেশীয় ঐতিহ্যে এবং মিথের সম্পৃক্তিকরণেরর মধ্যে দিয়ে। বিশেষ করে মিথের ব্যবহার, ভাঙন এবং মিথের পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে।
কবি তুষার গায়েন ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তার রূপের জগৎ থেকে পাল্টেছেন ভাববস্তুকে- পাল্টেছেন কথাবস্তুকে।
পতিব্রতা নারীর ভিতর থেকে প্রতিবাদী নারীটিকে প্রতিস্থাপন করেছেন আমাদের চৈতন্যের ভিতরে। তুষারের কাহিনী কোনো পাথুরে ভাষ্কর্য নয়- জলরঙে আঁকা একটি মহত্তম ছবি, যেখানে অনেক কিছুই সুপ্ত, ইঙ্গিতময়। পাঠককে শব্দের বাঁকে বাঁকে সে ইঙ্গিতকে দেখতে হয় শুধু চোখ দিয়ে নয়- চৈতন্য দিয়ে।

৬.
মূল ঘটনায় মালঞ্চমালা পাটরানী হয়েছেন। তুষার এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। তিনি মালঞ্চকে পাটরানী হবার পরিবর্তে স্বেচ্ছা নির্বাসনে পুনরায় পাঠিয়েছেন বনে। কারণ যে অপমান ব্যক্তি ও নারী হিসাবে মালঞ্চ পেয়েছেন তার প্রতিবাদ হিসাবে এমনটিই যেন মালঞ্চের মতো সাহসী ও গভীর অন্তঃকরণের নারীর সঙ্গে মানানসই। এটা শ্রেণী ও জাতপাতে বিভক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা তার সাহস ও ব্যক্তিত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ। এছাড়াও যে রাজপুত্রকে সে বড়ো করেছে কোলে-পিঠে, তার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা (মাতৃ ও স্ত্রী সত্তার দ্বন্দ্ব) তাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে, তাড়া করে ফিরেছে আজীবন দুঃস্বপ্নের মতো । একারণেই এর সহোদর কাহিনী ‘রুপবান’-এ শেষ দৃশ্যে বর্ণিত রহিম ও রুপবানের বিয়ের ঘটনাটিকেও তুষার অনুসরণ করেন নি।
আবার রাজকন্যা কাঞ্চীর সঙ্গে রাজপুত্রের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখা ও তাদের সামনেই সমগ্র বঞ্চিত জীবন পাড়ি দেওয়ার নির্মমতা অনুষ্ঠিত হতে দেয়া স্বাভাবিক জৈব-মানসিক ধর্মের বিরোধী। বনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই এই সব কিছুকে অতিক্রম করে যায়। রাজপুরী নয়, বনই তার নিজের ভূবন।
এটাই পুরণো মিথের ভিতর থেকে নতুন ভাববস্তুর সন্ধান ও আধুনিক বোধের সমন্বয়। মিথের সার্থক বিনির্মাণ। এরকম অনেক বিনির্মিত ঘটনা এবং উপলদ্ধির সমারোহ রায়েছে তুষারের উত্তরমালঞ্চ কবিতায়।

৭.
এই অসাধারণ লোকগাথা বা ‘বঙ্গীয় উপন্যাস’ কবি তুষার গায়েন স্থাপন করেছেন এক অনু-মহাকাব্যের আঙ্গিকে। কবিতা গল্প বা উপন্যাস নয়, কবিতা কবিতাই। অনেক গ্রহণ বর্জনের মধ্য দিয়ে কবিতাটিকে শব্দের যাদুতে বিনির্মাণ করেছেন।
তার বিনির্মিত কাহিনীটিকে তিনি সাতটি পর্বে ভাগ করেছেন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো করে।

প্রথম পর্ব- বনপ্রস্থান :
মাঘের শীতে একটি বনপথের দৃশ্য ভেসে ওঠে- সেখানে ধানকাটা মাঠে জ্বলছে নাড়ার আগুন। ধুঁয়া আর কুয়াশা মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াশায়। দৃশ্যকল্প বলে দিচ্ছে এটা এই একান্ত বঙ্গের ছবি। দেখা যায় এই বনপথে একটি সদ্য কিশোরী মেয়েকে, যার কোলে দিন কয়েকের একটি শিশু। এ শিশু মেয়েটির সন্তান নয়- স্বামী, যেন স্বাভাবিক মাতৃস্নেহে তার জন্য দুধ খুঁজছে। হিংস্র বাঘদের সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন, তার সতীত্বের ঘোষণা, শিশুটির সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ও সম্পর্কের জটিলতা, শিশুটি যেন চিরন্তন শিশুদের মতো তাকে মা বলে ডেকে না ওঠে এই শংকা, এই দূরাগত নির্জন একাকী জীবন, তার ভেতরের নারীটির রক্তমাংসের আকাঙ্খা, মানসিক ও শারীরিক জৈব ধর্ম- এইসব দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির একটি নাটকীয় উপস্থাপনা পাই।

থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে

এই পর্বের শেষাংশে দেখতে পাই, রাজপুত্রকে শিক্ষাদানের জন্য মালঞ্চমালা বন ছেড়ে লোকালয়ের দিকে যাত্রা করছে। স্কুলের ঘন্টা ও হ্রেষাধ্বনির উল্লেখ সেই আবহকে তুলে ধরে।

দ্বিতীয় পর্ব- স্মৃতি : বনে বাড়ে রাজার কুমার
ফ্লাশব্যাকে, রাজকুমারের বনে বড়ো হয়ে ওঠার চিত্রটা পাই। বনের উদার আশ্রয়ে বড়ো হয় রাজকুমার, যেখানে নেই লোকালয়ের ক্ষুদ্রতা ও জাতপাতের নিমর্মতা। মালঞ্চ তার শিশু স্বামীকে সন্তানস্নেহে বড়ো করে তোলে। কাজল আঁকে চোখে। এইখানে সেই চিরন্তন বাংলার রমণীকে পাওয়া যায়। মালঞ্চমালা নিজেকে শোনায়-

বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর

বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে।

তৃতীয় পর্ব- রাজটিকা :
রাজপুত্র রাজার ছেলে। কিন্তু মালঞ্চমালা কোটালকন্যা, নিচু বর্ণের। তবু নিজ দায়িত্বে তাকে রাজার ছেলের মতো তার বসন-ভূষণ-বাহন জোগাড় করে দেয়। তাকে রাজপুত্রের মতো বড়ো করে তোলে। হয়তো মনে সাধ, কুমার বড়ো হলে তাকে (মালঞ্চমালা) জানবে তার প্রকৃত পরিচয়ে, মূল্য দেবে তার আত্মত্যাগের ।

সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!

চতুর্থ পর্ব- পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি :
আরেকটি ফ্লাশব্যাক দেখি। সেই প্রথম দিনের ঘটনা যা ছিল মালঞ্চের জন্য ও তার পিতার জন্য অনিয়ন্ত্রিত। রাজার আদেশে একটি নিম্নবর্ণের ১২ বছরের মেয়ের সাথে ১২ দিনের রাজপুত্রের বিয়ে হল। শিশুর মৃত্যু, এই মৃত্যুর জন্য নিয়তিকে নয় মেয়েটিকে দায়ী করা, তাকে ডাইনী বলে ঘোষণা দেওয়া, চিতায় তোলা, বৃষ্টির কারণে আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া মৃত শিশুটিকে ভূত-প্রেতের ছোবল থেকে বাঁচানো ও তাকে নিয়ে গোপনে বনে চলে যাওয়া - এই যে একটি সামাজিক, শাস্ত্রীয় ও ক্ষমতার শিকার হয়ে একটি মেয়ে অসহায় হয়ে লোকালয় ছেড়ে প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিল - তার চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খার কোনো মূল্য নেই। এর কারণটির পেছনে রয়েছে ইতিহাসের কুটিল ছায়া। সেই ইতিহাসটি এসেছে ভারতে আর্যদের আগমনের সঙ্গে, যারা ঘোড়ায় চড়ে নেমে এসেছিল পাহাড় থেকে পলি সমতলে। সমগ্র সমাজ শ্রেণী বিভক্ত হয়ে যায় এই বিদেশী আর্যদের আগমন ও তাদের শাস্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে। এই ঘোড়ার প্রতীকটির সঙ্গে অনার্যদের সামাজিক অবস্থানের পতন – পতনের কারণ হিসাবে শাস্ত্রের উত্থান - এই ইতিহাসটাই এই পর্বে বর্ণিত হয়েছে।

পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে …
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।

পঞ্চম পর্ব- ধল প্রহরের গান :
রাজপুত্রকে বিদ্যালয়ে পাঠায় মালঞ্চমালা। সেখানে কেবল রাজসন্তান ও উচ্চবর্গীয়রাই যায় শিক্ষা নিতে। সেজন্য রাজপুত্রকে রাজার বসন-ভূষণে-বাহনে পাঠানো হয়। সেখানে রাজপুত্রের সাথে দেখা হয় এক রাজকন্যার। দুধবর্ন তার গায়ের বরণ এবং মর্যাদায় সমবংশীয়। মালঞ্চ নিজেকে আড়াল করে রাখে, যেন বেড়ে ওঠা রাজকুমার তাকে ভুল করে মা বলে না ডাকে। তবুও মালঞ্চের গোপন আকাঙ্খা যেন রাজকুমার একদিন জানতে পারে যে সে তার স্ত্রী - যে একাই সমাজ, শাস্ত্র, দুর্যোগ ও সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রাণপন সংগ্রাম করে তাকে বড়ো করে তুলেছে এবং এই নারীটিকে তার নিজস্ব নারী হিসাবেই যেন অন্তত একবার হলেও রাজকুমার মূল্য দেয়।

দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে !

ষষ্ঠ পর্ব – দাঁতে কাটি কারাগার :
ভিনদেশী রাজার আক্রমণে পরাজিত শ্বশুর-রাজা ও স্বামী বন্দী রাজপুত্রকে উদ্ধারের সেই ঘটনাটি দেখতে পাওয়া যায়। বনে একা থাকা মালঞ্চমালা খবর পেয়ে তার স্বামী ও শ্বশুরকে উদ্ধার করে বাঘ বাহিনী নিয়ে। নিজের দাঁত দিয়ে স্বামীর শিকল কেটে তাকে মুক্ত করে। এক একটি দাঁতের বিনিময়ে এক একটি শিকলের বন্ধন কাটে মালঞ্চ। তাতে যে রক্তদর্শন ঘটে, তা এক ভিন্ন অনুভবে মালঞ্চের মনে সুপ্ত মিলনের আকাঙ্খা জাগিয়ে যায়। কেননা সতী নারী রক্তপাতের মধ্য দিয়েই প্রথম স্বামী মিলনের তৃপ্তি ও সুখ পায়। মালঞ্চ এইখানে তার স্বপ্ন- আকাঙ্খার কথা বলছে –

দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে

সপ্তম পর্ব – বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল :
এই শেষ পর্বে গল্পের পরিণতি ঘুরে যায়। যে বিপুল আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের বিনিময়ে মালঞ্চমালা তার অসম বয়সী স্বামীটিকে বাঁচিয়েছে, তার শ্বশুরকে বাঁচিয়েছে - তার বিনিময়ে সে পায়নি তার প্রাপ্য অধিকার, সম্মানিত স্ত্রী ও আকাঙ্খিত ঘর সংসার। বরং পেল বনবাস যার চেয়ে মৃত্যুকেও তার প্রিয় মনে হয়। তাই তার আর্ত উপলব্ধি শুনি যে, ভালবেসে দাঁত দিয়ে শিকল কাটা যায়, কিন্তু মনের দেয়াল কাটা যায় না।
দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট

কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস

আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…
এইখানে এসে চোখে জল আসে। এই বঞ্চিত নারীর জন্য আমাদের হৃদয় ভেঙ্গে পড়ে। শাস্ত্রের প্রতি জমে ওঠে ক্রোধ। আমরাও তাই সমর্থন করি তার বনে ফেরা- যেখানে জাতপাতের বিভাজন নেই, আছে ভালবাসা- যা উন্মুক্ত, উদার, অখণ্ড-

তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।

৮.
কবিতার শুরু বনে। শেষও বনে। বনমর্মর শোনা যায় কবিতার প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি বাক্যে- কথাবস্তু ও ভাববস্তুতে। এই বন সহজ সরল, স্বাভাবিক, সপ্রাণ ও সবুজ। এখানে গাছপালা, পশুপাখি, নদীজল- আকাশবাতাস, মেঘ ও মাটি- একীভূত। অখণ্ড সত্তা। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই। নেই বিভাজন। আছে উদার ঐক্য। অখণ্ড একাকার হয়ে যাওয়ার টান। শুভর সঙ্গে মিলনের বোধ।
যে কারণে শাস্ত্রবদ্ধ মানব কখনো কখনো বনবাসীর সন্দেহর কারণ হয়ে ওঠে। আবার যখন বোঝে, যে মানুষ শাস্ত্রবিহীন, প্রকৃতির মত সৎ বনে আশ্রয়প্রার্থী- তাকে আশ্রয় দেয় মায়ের মতন। বন যেন মা। আদিমাতা। তার অধিবাসী গাছপালা, পশুপাখিও এই মাতৃস্নেহ জানে – মাতৃস্নেহ মানে। সবাইকে কোলের আশ্রয়ে ধরে রাখে। কাউকে বিমুখ করে না। যে কারণে দেখি, বাঘ রাজপুত্রকে খেতে চায়। কিন্তু ব্যাঘ্রসমাজ মালঞ্চমালার সত্য কথনে মুগ্ধ। তারা শিশুটির জন্য গাছে গাছে যায় খাবার আনতে। গাছও তাদের দেয় অবারিত মধু। পথে পথে মেলে দুধ। এবং মেয়েটির জন্য তারা লড়াই করে বিভাজনকামী মানুষের বিরুদ্ধে। আক্রান্তদের বাঁচায়। আবার ন্যায়বোধে অন্যায়কারী শ্বশুরশ্বাশুড়ীকে খেতে চায়। মেয়েটির অনুরোধে তাদের ক্ষমাও করে দেয়। এই যে বাঘের ভেতরে দেখি সেই মহৎপ্রাণের উৎসারণ- যার ভেতরে নেই অশুভ ভাবনা। আছে ন্যায়বোধ ও মমতার সঘন হৃদয়।
আর গাছ প্রকৃতির অখণ্ড প্রতীক। গাছ তার ভিতরে ধরে রাখে প্রকৃতির বিশালতা। দানধর্ম। সুন্দরের আকাঙ্খা। কাউকে সে দূরে ঠেলে দেয় না। দেহ ও মনের খাদ্য সে যোগায় মায়ের মতোন। তার পাতাটি, ফুলটি, ফলটি, শাখাটি দানধর্মে প্রবল। আর শেকড় যেভাবে আকড়ে ধরে মাটিকে- কালের করাল গ্রাস থেকে ফেরায় মাটিকে, বাতাসকে, আলোকে- সে রকম আমরা দেখি গাছ সমগ্রকে ধরে রাখে। ছায়াটিকে ধরে রাখে। ছায়াটি হারিয়ে গেলে তার কঙ্কালটিকেও ধরে রাখে। কাউকে সে হারায় না। একাত্ম করে রাখে। এই খণ্ড- খণ্ডের সঙ্গে অখণ্ডের মিলনের খেলা তাই অতি স্বাভাবিক ও মহত্বের ইঙ্গিত।
প্রকৃতির শান্ত সুরটিই এ কবিতার প্রাণের সঙ্গীত। প্রকৃতির অখণ্ড বোধই এ কবিতার প্রাণ।

৯.
এই মর জর্জর, ষড়যন্ত্রময় জগৎ থেকে আমাদের ফেরায় এ কবিতাটি সেই দীর্ঘ শমিত অভিযাত্রায়- মাঘশীতে, ডোরাকাটা বনপথে, নাড়ার আগুনে, কাঁপা কাঁপা ছায়ার ভেতরে, অতল রাত্রিতে, জলে ভেসে যাওয়ার মধ্যে, পানকৌড়ির উড়ে যাওয়ায়, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে, মেঘে,মেঘের পালঙ্কে, বনমধুতে, আকাশময় আকাশে, কচুপাতায়, স্নিগ্ধ পলি সমতলে, শ্বেতপঙ্খীতে, পাহাড়ের ক্ষতে, জলের আর্তিতে, একটি বা দুটি তারায়, সরোবরে, পাতাস্রোতে, রোদ এবং ছায়ার কঙ্কালের ভেতরে, রূপের ভেতরে, প্রাণের ভেতরে। জীবনের প্রাণবন্ত অস্তিতে।
এ কবিতার আয়োজন যে শব্দে নির্মিত হয়- তারা সব সত্য শব্দ, সপ্রাণ এবং আত্মার ধ্বণিতে মুখর। তারা পাতার মতো মর্মরিত, আলোর স্পর্শে পুষ্টি যোগায় কবিতার গাছটিকে। শব্দগুলি ফুলের পাপড়ির মতো লাবণ্যময়, সুবিন্যস্ত। রচনা করে একটি ফুলজীবন- তার আছে ঘ্রাণ- আছে রঙের ইশারা, যা প্রজন্মকে ডেকে আনে। আরেকটি ফুলের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে আছে সৃজনের সক্ষম সামর্থ্য। অপ্রয়োজনের ভার কোনো শব্দ কাঠামোর ভেতরে ও বাইরে চিহ্ণিত হয় না।
কবি তুষার বলেছেন একটি রূপকথা- রূপের জগতের ভেতরে রূপের কথা, আরও গভীরে লুকিয়ে থাকা চুপকথা। এজন্য তিনি নির্মাণ করেছেন একটি পৃথক কাব্যভাষা। যা শান্ত, মন্দ্র এবং প্রাণোৎসারিত। যেমন আমরা দেখতে পাই-

মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী

থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে

এ ভাষার মধ্যে সেই প্রাচীন রূপের জগতের মন্দ্রতা বোঝাতে ব্যবহার করেছেন দূরাবহ, রাত্রি, ভ্রম গুরুগম্ভীর শব্দ। আবার সমকালীন করে তুলেছেন- ডোরাকাটা, নাড়া, বাঘমামা- এইসব সহজ সরল প্রতিদিনের ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। এই মন্দ্র ও সরল শব্দ আশ্চর্যভাবে মিলিত ঐক্যতান সৃষ্টি করে- যা তুষারের কাব্য-সামর্থ্যের বিশেষ প্রকাশ।
যে কোনো শব্দের দুটো দিক থাকে। এক. তার অর্থের দিক। দুই. তার রস-প্রতীতির দিক। গদ্য শব্দের আক্ষরিক অর্থকে প্রধানত ধারণ করে। কিন্তু কাব্য উন্মোচন করে শব্দের রস-প্রতীতি বা রহস্য ও ব্যঞ্জনাকে। ‘সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে’- এইখানে শব্দের অসাধারণ যাদুকরী ব্যবহার করেছেন তুষার। মেয়েটি ১২ বছরের। সবে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে। তার ভেতরের নারীটি জেগে উঠেছে। ঋতুচক্রের যে নম্র লজ্জা এবং নারী হয়ে ওঠার গৌরব- এই দুটি বিষয়কে একই সঙ্গে তুষার ব্যবহার করেছেন ‘সলাজ রক্তের গান’ শব্দবন্ধটি। যে গানটির মাধ্যমে আবেদন জানাচ্ছে পুরুষটিকে- সে শিশুমাত্র। এখন এই সলাজ রক্তের গানের কোনো মানে নেই। কিন্তু একদিন মানে হবে। তার জন্য আছে অপেক্ষা। বহু বছরের প্রতীক্ষা।
এই রকম শব্দের অন্তর্গত আবেগ, সমাবেশ ও ধ্বনি বৈচিত্র্য এবং ছন্দের শোভনতা নিয়ে নির্মিত হয়েছে উত্তরমালঞ্চ কবিতাটির রূপময় ভাষা। হয়ে উঠেছে অনির্বচনীয়।
এবং রূপময় ভাষার অর্ন্তগত প্রতিটি বাক্যে প্রতিটি শব্দের মধ্যে আছে অন্বয় । আছে বাক্যের সঙ্গে বাক্যের অন্বয়। কোনো বাক্যই দুর্বল বোধ হয় না। হাত ধরাধরি করে কবিতার দিকে পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায়।

ক) ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
!
খ) মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
!
গ) বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
!
ঘ) তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
!
ঙ) আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!

প্র্রতিটি বাক্যই চমকে দেওয়ার মতো। প্রথম বাক্যে সামন্ত জীবনের বিলাস ব্যসনের অহংকার বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে মেঘের সরল সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। কিন্তু পরের বাক্যে দেখি রাজার কুমার সে কৃত্রিম বৈভবের মধ্যে নেই। তাই মেঘের সরল অলংকার তার পালঙ্ক হয়ে উঠেছে। এই মেঘের সৃজনশীলতার মধ্যে তার বর্তমান বন-বসবাস এবং আনন্দময় বেড়ে ওঠা। সেই বনের অখণ্ড সত্তার মধ্যে বেড়ে ওঠা- যেখানে লোকালয়ের ঈর্ষা-হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতা নেই , আছে কল্যাণের, বিস্তার যাকে তুষার বলেছেন- দানধর্ম। এই বাক্যটিকে একটু নিবিড়ভাবে দেখলেই বোঝা যায়- তারা আলাদা আলাদা বাক্য , আলাদা আলাদা চিত্র, কিন্তু একটি অখণ্ড চিত্রের দিকে- সম্পর্কের দিকে আমাদের সঙ্গী করে নিয়ে যায়, গভীর রহস্যের মধ্যে দিয়ে গাথা হচ্ছে একটি মালা। প্রতিটি পঙক্তিই মালাটির সমান লাবণ্যের ফুল। কোনোটি তাজা বা কোনোটি মৃত নয়। সকল শব্দই জীবন্ত। কোনো শিথিলতা নেই।

১০.
কবিতার ছন্দটি কথাবস্তু ও ভাববস্তুর মতোই নিখুঁত।
এ ছন্দ কান ও মনকে স্নিগ্ধ করে। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ভিতরকার ঋদ্ধ প্রাণের সুরটিকে প্রাণে পৌছে দেয়। বোঝা যায় কাব্য ও ছন্দ অঙ্গাঙ্গীভাবে বাঁধা। কেননা ছন্দ আর আবেগ যমজ। যেমন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত জানান, এই ছন্দ কৃত্রিম গণিত সাপেক্ষ মাত্রা গণনা নয়। তা কুস্তি করে সাজানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তা নাচের তালের মতো স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গি। আর আমরাতো এই ভঙ্গিটিকে মুখ্যত দেখি না। ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দকে দেখতে চাই- যে আনন্দ কবিতারই অন্য নাম।
১১.
এ সময়ের অনেক কবি শেকড়ের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। লিখছেন- মিথ নির্ভর কবিতা। মাটিবর্তী কবিতা। সে সব কবিতার মধ্যে যতো রয়েছে অহংকার আর নির্মাণ-চতুরতা- কিন্তু নেইস্বদেশ শেকড়ের আবিষ্কার। তাই কোনো কোনো কবিতা হয়ে ওঠ শব্দের সম্ভারমাত্র, শব্দের চমক অথবা দুএকটি বাক্যের স্ফূর্তিমাত্র। সেখানে যে আকাশ বর্ণিত হয়, যে জল ও মাটির ভুবন দৃশ্যমান হয়, তার সাথে আমাদের বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া কষ্টকল্প হয়ে ওঠে। শেষমেষ তা হয়ে ওঠে- ঘোড়ার ক্ষুরের ধ্বনির ব্যর্থ অনুকরণ। যে মেয়েটিকে সে সব কবিতায় দেখতে পাই সে ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বিল্ডিং-এর ছাদে উঁকি মারে, যে ছায়াটিকে চোখে পড়ে তা ড্রাগনচিহ্ণিত কোন অপচ্ছায়া মাত্র, যে গাছটিকে লক্ষ্য করি- তা আসলে কোনো গাছ নয়- গাছের কঙ্কাল- বনসাই।
আর প্রকৃত আকাশ দেখা যায় এই ‘উত্তরমালঞ্চ’ কবিতায়। এ কবিতার আকাশ তা আমাদের বাংলাদেশেরই আকাশ, এ কবিতার জল আমাদের নদী ও পুকুরের জল। আমাদের আলো ও হাওয়ার ভিতরের জীবন-নিসর্গের রূপময়তা এ কবিতার ছত্রে ছত্রে। যে গাছটি সবুজ হয়ে ওঠে আমাদের চোখের সামনে, তা আমাদের আত্মার অখণ্ড আশ্রয়। আমাদের জীবন যা প্রকৃতিরই খণ্ডাংশমাত্র- যার মূল প্রবণতা প্রকৃতির অখণ্ড প্রাণের ভিতর ফিরে যাওয়ার- সে প্রাণকে ধারণ করে আছে প্রকৃতই কবি তুষার গায়েনের কবিতা।
(ফরহাদ মুস্তাফার নোটের লিংক-http://www.facebook.com/note.php?saved&&suggest¬e_id=227641105337#/note.php?note_id=115371264616&ref=mf )
তথ্যসূত্র:১.আধুনিক সাহিত্য : গোপাল হালদার। ২. রূপকথা : শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩.পটুয়াশিল্পী : যামিনী রায়। ৪. কাব্যের মুক্তি : সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। ৫. বৃষ্টির অন্তর ত্রাস : তুষার গায়েন, নিসর্গ প্রকাশন, ঢাকা।
মূল কবিতাটি-
উত্তরমালঞ্চ
বনপ্রস্থান

মাঘশীতে ডোরাকাটা যায় দূর বনপথ
কুয়াশারেখায় ঢাকা পথ নেই পথ নাড়ার আগুন
ফিক ফিক করে জ্বলে নেভে ধোঁয়াশা ছড়ায়
দূরাবহে হেটে যায় পরী, কোলে তার
শিশু নয় স্বামী, বারোদিন রাত্রি কেটে যার
আয়ু হল কাল; পথে পথে কে আছে তাঁকে
দুধ দেবে ওগো, বাঘমামা আমি সতী নারী

থাকি ভয়ে ভয়ে এই ভ্রমে এই যদি মা বলে ডাকে
বিজন বনের পথে দূরাভাসে ছায়া কাঁপা কাঁপা
অতল রাত্রির থেকে জল ভেসে আসে, উথলে উথলে
ওঠা জল দু’চোখ বিহনে যাবে কোথা পাবে কোথা পথ
নেই পথ নেই পথ সতীধর্ম যৈবন নদীর
দু’কূল ছাপায়ে ওঠে বাষ্পে বাষ্পে ভারী
অবরুদ্ধ গীতি… গেয়ে যাও পানকৌড়ি
সলাজ রক্তের গানে প্রতীক্ষিয়া প্রতীক্ষিয়া বহু বর্ষ কাটে

বাঘমামা, যদি না থাকিতে বনে…এইবার যাই!
পালাই পালাই বন থেকে দূরে লোকালয়, বিদ্যালয়
প্রথম পাঠের ঘণ্টাধ্বনি, হ্রেষা শোনা যায়…

স্মৃতি: বনে বাড়ে রাজার কুমার

ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে সরে যায় মেঘ
মেঘের পালঙ্কে শুয়ে রাজার কুমার
বনে বাড়ে, বন সে’তো দূরে নয় লোকালয় থেকে
তবুও বনের মনে কী গভীর রহস্য আছে
আছে দানধর্ম তার, লোকালয়ে নাই!
জানে তাই বাঘমামা গাছ থেকে মধু পেড়ে আনে
শিশু স্বামীটিরে কি খাওয়াবো, কি রাঁধি
কোলে নিয়ে বসে থাকি, কাজল এঁকেছি চোখে তাঁর

বিতাড়িত পথে পথে দুধের ফোয়ারা ছুটে আসে
এই দুধ ঠোঁটে মুখে তাঁর মেশে সকল অব্যয় ধ্বনি
যেখানে মানুষ নেই, আহা-
মমতা সেখানে জানি, ঘর বেঁধে রাখে!

রাজটিকা

কোটালকন্যার হাতে যদি বাড়ে রাজার কুমার
তবু সে’তো রাজপুত্র, রাজধর্ম তাঁর
একযুগ পার হলে যেন সব চিহ্ণ
সমান স্বরূপে ফুটে ওঠে তাঁর, এই ভার
নিয়েছি নিজের বোধে…কেউ জানে নাই
সকলেই জানে সে’তো বহুপূর্বে মৃত ছিল
চিতায় পুড়েছে ঘন বর্ষার রাতে
মরা কি জীয়ন্ত হয়, যদি না সে জাতিস্মর
বেভুলে কখনো কারো হঠাৎ অতীত মনে পড়ে!

পাপসূত্র, মৃতের জীয়নকাঠি

মৃতের শরীর থেকে মৃত্যু উড়ে গেছে
জীবন চিৎকার করে নামে সেইরাত
চোখের কোটরে দেখি আবার চোখের জল
ধুয়ে যায় দৃশ্যগাঁথা বন সর্ সর্
বিদেহী ছায়ারা দ্রুত মিশে যায় বাষ্পীভূত
আকাশে আকাশময় জড়ো হয় মেঘ
বড় বড় বৃষ্টিফোঁটা ধারা হয়ে নেমে আসে
ন’ড়ে চ’ড়ে কচুপাতা কিছু জল ধরে রেখে
বাকিটুকু ফেলে দেয় পতনের প্রেমে:
পতন পতন শুধু ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে
পতনের শুরু; আমিও পতিত তাই
কাল সব জানে, তারা কারা এসেছিল
পাহাড় প্রদেশ থেকে নেমে এই স্নিগ্ধ পলি সমতলে…
লালধ্বনি হ্রেষা আনে সকল বিভক্তি রীতি
শাস্ত্র নামে ঘটে গেছে জানি, বহুকাল আগে।

ধল প্রহরের গান

ওঠো ওঠো রাজার কুমার বিদ্যালয়ে যাও
বিদ্যালয়ে তোমার সমান রাজকন্যা পাও
দূধের বরণ রাজকন্যা শ্বেতপঙ্খী নায়ে
এনে দেবো পঙ্খীরাজ চিঁহিঁ রবে গায়
দূরে দূরে থাকি যাতে অসম বয়সে
ভুল ভেবে না ডেকো গো, মা বলে আমাকে
আমি যে গো তোমার জায়া এই সত্য জেনে
দেখো ফিরে একবার এই একাকী নারীকে!

দাঁতে কাটি কারাগার

দাঁতে কাটি শিকলের বেড়ি, লোহার শিকল
সে নয় কঠিন এই ইচ্ছার থেকে
রক্তদর্শন ছাড়া জানি সুখ হয় না কখনো
এই রক্ত সুখ হবে যদি বাঁচে সাধের কুমার
তুমি স্বপ্নে উঠে এসো ক্রোড়ে, বনে বনে কেটেছিল
যদি অভয় নিদ্রার কাল, নিদ যাও নিদ যাও বুকে
তোমার তরুণ মুখ পিপাসার মত
পাহাড়ের ক্ষত থেকে জলের আর্তি আসে ছুটে
‘বাঘমামা, খেয়ো না খেয়ো না, এই কাঞ্চী কুমারের নিধি
এত সাধ রক্তপানে যদি, তবে খাও আমাকেই আগে’…
একে একে দাঁতের বিনাশে কাটে শিকলের ভার
কাক ডাকে ভোর হয় ফর্সা আকাশে
নিথর একটি, তবু, দু’টি তারা থাকে!

বনে ফেরা, ছায়ার কঙ্কাল

দাঁতে কাটে কারাগার মনের দেয়াল কাটে নাকো
গ্রহণের সীমারেখা মানুষের এত ছোট এত ছোট

কুমারের আয়ু আজ অনন্ত আকাশ
তবু রাজা আমায় দিলেন বনবাস

আমি যে কোটালকন্যা অবরুদ্ধজন, পথে পথে কাঁটা
সরোবরে ডুব দেবো সেখানে পাহারা…

রাজা আমায় নিলেন নাকো ঘরে, না দিলেন মৃত্যুপরোয়ানা!

তবে আমি বনে যাই যার শাস্ত্র নাই কোনো
এই পথ চলে গেছে দূর পাতাস্রোতে
পাতার আড়ালে গাছ ধরে রাখে ছায়ার কঙ্কাল
রৌদ্র হলে জানি তাই মেলে দেবে পথে।

‘রাধিকা পুরান’-এর ছন্দ বিশ্লেষণ নিয়ে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও সোহেল হাসান গালিবের সাথে বিতর্ক তুষার গায়েন


কবি তুষার গায়েনের নোট : ছন্দের তর্ক থেকে যত সংজ্ঞাবিধি

‘রাধিকা পুরান’-এর ছন্দ বিশ্লেষণ নিয়ে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ ও সোহেল হাসান গালিবের সাথে বিতর্ক
তুষার গায়েন

প্রিয় বন্ধুগণ, যে আলোচনাটি আমি এখানে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি তার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় দেড় মাস আগে। সতীর্থ কবি শাহানা আকতার মহুয়ার একটি ছোট্ট কবিতা ‘রাধিকা পুরান’-এর ছন্দের মাত্রা গণনা নিয়ে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে আমার বিতর্ক শুরু হয়। বিতর্ক অচিরেই আর মাত্রা গণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা তেজস্ক্রিয়তার মত ছড়িয়ে পড়ে ছন্দ সম্বন্ধীয় অন্যান্য সংজ্ঞা ও প্রচলিত প্রত্যয় সমূহের কেন্দ্রেঃ সিলেবল কি? সিলেবলের বাংলা নাম কি? সিলেবল ও অক্ষর কি সমার্থক? সিলেবলের পরিমাপ কি? ইত্যাদি... ইত্যাদি...। আলোচনার এক পর্যায়ে কবি সোহেল হাসান গালিব অংশগ্রহণ করেন এবং বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। গালিব তার বক্তব্যের সপক্ষে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে দু’টো বই (ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় / ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই) হাজির করেন এবং দাবী করেন যে, যদি আমাকে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা চালিয়ে যেতে হয় তাহলে, উপরোক্ত বই দুটো আমার পড়া ও অনুধাবনে থাকা আবশ্যিক। অগত্যা আমাকে বই দু’টো জোগাড় করে পড়তে হল। প্রবাসে বসে এইসব বইপত্র জোগাড় করা দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ, তবু আলোচনার স্বার্থে এই বই দু’টোই শুধু নয়, আরো অনেক কিছুই নতুন করে পড়তে হ’ল এবং বোঝা গেল যে, আমরা বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের কোথায় দাঁড়িয়ে আছি এবং কেন আমাদের মধ্যে এই মতপার্থক্য হচ্ছে। এই লেখাটি উন্মোচন করবে বাংলাভাষার এমন এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ও ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা, যার সাথে অনেকেই অপরিচিত অথচ যার পরাক্রান্ত আহ্বান আমরা কেউ উপেক্ষা করতে পারি না। আলোচনাটি ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করার সুবিধার্থে, আমি পূর্বের আলোচনার লিঙ্ক শুরুতেই দিয়ে দিচ্ছিঃ

1.http://www.facebook.com/profile.php?id=1123716726#/note.php?note_id=208314290124

2.http://www.facebook.com/profile.php?id=1123716726&ref=ts#/note.php?note_id=80303980417


গালিব, যে বিষয়গুলো নিয়ে আপনার ও কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে আমার মতপার্থক্য হচ্ছে, যেমনঃ অক্ষর, সিলেবল, ছন্দের মাত্রা এবং প্রাসঙ্গিক আরো কিছু যা এই আলোচনার উপজাত, সে-সব বিষয় নিয়ে নির্দিষ্টভাবে ব্যাখা-বিশ্লেষণ হাজির করার আগে, প্রাথমিক কিছু কথা সেরে নিতে হবে। বাংলাভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে কোনো দূরদর্শী ও পরিণত আলোচনা করতে গেলে, সেটা বাংলাভাষার সমগ্র ইতিহাস(অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত) -এর উপর দাঁড়িয়ে করতে হবে, না হলে সে আলোচনা খণ্ডিত হতে বাধ্য। বাংলাভাষার বিবর্তনের একপর্যায়ে, ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে, বিশেষতঃ ইংরেজ আমলে ইংরেজি জানা বাঙালি পণ্ডিতরা বাংলাভাষাকে ইংরেজির আদলে গড়তে গিয়ে, ভাষার যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন করেছিলেন, অর্থগত ও কাঠামোগতভাবে, তার রেশ আমাদের এখনও বহন করতে হচ্ছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলাভাষার যে ব্যাকরণ প্রণয়ন করেছিলেন (যে ধারাতে পরে আরো অনেকেই এসেছেন যেখানে আবদুল হাই-ও অন্তর্ভূক্ত) যার উপর ভিত্তি করে আজকের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভাষাব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে, তা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন।

পৃথিবীর ভাষা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বাক্যে ব্যবহূত শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করার দু’টো পদ্ধতি রয়েছে। তার একটি হচ্ছে, শব্দের বাইরে থেকে শব্দের অর্থ পাওয়া, যেখানে শব্দটি একটি আরোপিত অর্থ বহন করে এবং যে ধ্বনি সমবায়ে ঐ শব্দটির জন্ম, ঐ ধ্বনিগুলো আলাদাভাবে কোনো অর্থ বহন করে না। ভাষার এই ধারাটিকে প্রতীকী ভাষা (logocentric) বলা হয়। অন্য পদ্ধতি হচ্ছে, ক্রিয়াভিত্তিক (verb-based) শব্দার্থবিধি, যেখানে কোনো একটি শব্দের ভেতর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন করা হয় অর্থাৎ যে ধ্বনি সমবায়ে ঐ শব্দের জন্ম, ঐ ধ্বনিগুলির সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে এবং ধ্বনিগুলির সম্মিলনেই শব্দের অর্থ নির্ধারিত হয়। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ প্রায়শই অনেক অর্থ বহন করে। সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার বিলুপ্তি হলেও, বাংলাভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক ও প্রতীকী, উভয় ধারার চর্চাই ইংরেজ আগমনের আগ পর্যন্ত বহাল ছিল, যখন অনেক প্রাচীন রচনাকে একই সাথে প্রতীকী ও ক্রিয়াভিত্তিক উপায়ে পাঠ করার নিয়ম চালু ছিল। একটি উদাহরণ এখনও আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, তা হ’ল চর্যাপদ। ঐতিহাসিকভাবে, ক্রিয়াভিত্তিক বাংলাভাষাকে যা ধারণ করে রেখেছে তার মধ্যে বিশ্বের আদি শব্দকোষ যাস্কের ‘নিরুক্ত’ (খ্রিস্টপূর্ব ৪০০), বৌদ্ধযুগের ‘অমরকোষ’ (৭০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ (১৯০০ খ্রিস্টাব্দ) উল্লেখযোগ্য। এই ধারাকেই সম্প্রতি কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী বিকশিত করে চলেছেন। অপরদিকে বাংলা ভাষার প্রতীকী ধারা নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ করেন পাণিনি, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির ধারাকে পাশাপাশি বহাল রেখেই। ইংরেজ আমলে, ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি পণ্ডিত ইংরেজি ভাষার জ্ঞান দিয়ে যখন বাংলাকে বুঝতে ও সে অনুযায়ী সংস্কার করতে গেলেন, বাংলাভাষা তার স্বভাব ও বৈচিত্র্য থেকেই শুধু বিচ্যুত হ’ল না, শব্দের ভয়াবহ অর্থ সংকোচন ঘটে গেল, একটি সংকর বা জগাখিচূড়ী ব্যাকরণের অধিকারী হল’ এবং প্রতীকী ইংরেজি ভাষার আদলে প্রতীকী বাংলাভাষার সূত্রপাত ঘটে গেল। সুনীতিবাবুই সেই কর্মটি প্রথম সম্পাদন করেন।

এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী তাঁদের যৌথ আলোচনা ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’-য়, যা পাওয়া যাবে তাঁদের ওয়েবসাইট www.banglasemantics.net-এ, যার লিংক আমি আলোচনার শেষে দিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে ক্রিয়াভিত্তিক শব্দ নিয়ে যে শব্দকোষ তৈরী করেন (বঙ্গীয় শব্দকোষ), সেই ধারাকেই সম্প্রতি ভাষাতাত্ত্বিক ও লেখক কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তী বিপুল সমারোহে বিকশিত করে চলেছেন নব নব আবিষ্কার ও অর্থদ্যোতনা যোগ করে। তাঁদের এই বিপুল শ্রম ও আবিস্কারের ফসল নতুন ‘বঙ্গীয় শব্দার্থ কোষ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হবে এ বছর অক্টোবর মাসে। আমাদের আলোচনায় যে-সব শব্দের সংজ্ঞা ও তার কলকব্জা নিয়ে আমরা বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছি, আমার বিশ্বাস এ বিষয়ে কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর গবেষনা ও আবিস্কারের সহায়তা নিয়ে আমরা তার অনেক যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছুতে পারব। এক্ষেত্রে www.banglasemantics.net-এ প্রকাশিত তাঁদের নিবন্ধ ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’ হবে আমার অন্যতম উৎস।

এখন দেখা যাক, আমাদের বির্তকের বিষয়গুলো নিয়ে। এর একটি ছিল সিলেবল, যার দুটি বিষয় নিয়ে আমাদের ভেতর মতপার্থক্যঃ সিলেবল কি অক্ষর? উচ্চারণের কোন পরিমাপকে আমরা একটি সিলেবল বলে গন্য করব? প্রথম কথা হলো, সিলেবল বাংলা ভাষার নিজস্ব বিষয় নয়। এটা ইংরেজি ব্যাকরণ থেকে আমদানী করা হয়েছে যা বাংলাভাষার স্বভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ ইংরেজি ভাষায় সিলেবল যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, সেই ধারণাই বাংলাভাষার সাথে বিরোধাত্মক। কোনো শব্দ যে-সব ধ্বনি সমবায়ে তৈরী হয়, সেই ধ্বনি সমূহের কোনো একটা পরিমাপকে সিলেবল বলে (কি সেই পরিমাপ, সেই তর্কে পরে আসছি)। এখন ইংরেজি ভাষায় ধ্বনির ধারণা বাংলা ভাষায় ধ্বনির ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত। দেখুন এ বিষয়ে কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বক্তব্যঃ “কলকাতার সংসদ বাংলা অভিধান (স.বা.অ.) ‘ধ্বনি’ শব্দটির অর্থ দিয়েছে – শব্দ, রব ... ইত্যাদি। ঢাকার ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (বা. বা. অ.) শব্দটির অর্থ দিয়েছে - শব্দ, কণ্ঠস্বর, রব ... ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই অভিধানগুলি ‘ধ্বনি’ বলতে প্রধানত ‘আওয়াজ’ বা sound বোঝে। তাদের এই ধারণা সমর্থিত হয় সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ সাম্প্রতিক কালের সমস্ত ভাষাতাত্বিক, বাংলাভাষী grammarian ও phonologist-দের লেখাজোখা থেকে। তাছাড়া, সুনীতিবাবু তাঁর ‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে ধ্বনির সংজ্ঞা লিখে গেছেন, ‘কোনও ভাষার উচ্চারিত শব্দকে (word) বিশ্লেষণ করিলে, আমরা কতকগুলি ধ্বনি (sound)পাই।’ (২.১.১.১)

এদিকে আমরা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধিতে ‘ধ্বনি’ শব্দের অর্থ পেয়েছি ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় আওয়াজ’ বা ‘meaningful active sound’। সুনীতিবাবু ইংরেজি sound শব্দের প্রতিশব্দ করে দিয়েছেন আমাদের ‘ধ্বনি’-কে এবং এর ভিতরে যে ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় বা ‘meaningful active’ ব্যাপারটি ছিল, তা বর্জন করেছেন। অন্যেরা তাঁকেই অনুসরণ করেছেন। তাঁর এরকম সিদ্ধান্তের ফলে ‘ধ্বনি’ শব্দটি রাতারাতি অর্থহীন নিষ্ক্রিয় sound মাত্রে পর্যবসিত হয়েছে, ‘ধ্বনি’ নির্ধন হয়ে গেছে। ক্ষতিটা এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এরপর আধুনিক বাঙালিরা গেছেন পাশ্চাত্যের Phonetics, Phonology ইত্যাদি শিখে বাংলাভাষায় ধ্বনিতত্ত্বের চর্চা করতে। ফল আরও মন্দ হয়েছে। বহুকালক্রমাগত আমাদের ‘অর্থপূর্ণ সজীব আওয়াজ’–এর চর্চা পরিণত হয়েছে ‘অর্থহীন সজীব আওয়াজ’-এর চর্চায়। ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে সুনীতি পরবর্তীকালে রচিত সমস্ত বাংলা গ্রন্থ এভাবেই দূষিত হয়ে গেছে। ... ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির অর্থ নিষ্কাশনের যে রীতি, তাতে প্রতিটি বর্ণের একপ্রকার সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকে এবং তা সমস্ত শব্দের ক্ষেত্রেই একই ভাবে প্রযুক্ত হয়। আমরা সেই সর্ব শাব্দিক বর্ণার্থের নীতিই অনুসরণ করেছি। তাতে প্রতিটি বর্ণের যেমন যেমন অর্থ আমরা পেয়েছি, তাই ধরে ধরেই শব্দগুলির অর্থ নিষ্কাশন করছিলাম। সেই নিয়মেই শব্দের গভীরে অব্যক্ত, আধা-অব্যক্ত, প্রায়-ব্যক্ত যেসব অর্থ পাচ্ছিলাম, তাকেই সম্পূর্ণ ব্যক্তরূপে তুলে প্রকাশ করছিলাম; সে রকমই করে গেছেন আমাদের পূর্বসূরী হরিচরণ, অমরকোষ, যাস্ক, প্রমুখ পূর্বাচার্যগণ। সে নিয়মেই ‘ধ্বনি’ শব্দের আধা-অব্যক্ত অর্থ পেয়েছিলাম, ‘ধ্ব-এর(=ধারণবাহীর)ন্ (-রহস্য রুপ) া -কার (-গতিশীল যাহাতে)। তাকে ব্যক্তরূপে তুলে আনলে অর্থটি দাঁড়ায় ‘ধারণাপূর্ণ সক্রিয় আওয়াজ’ বা ‘meaningful active sound’। আমাদের ইচ্ছা- অনিচ্ছা থেকে ‘ধ্বনি’ শব্দের এরকম অর্থ হয়নি। ‘ধ্ব’-এর যা মানে, তাকে কেবল ‘ধ্বনি’-র ক্ষেত্রে বিরাজিত ভাবলে চলবে না, একই সঙ্গে ‘ধ্বজা’ বা ‘ধ্বংস’ শব্দের অর্থের সঙ্গেও খাপ খেয়ে যেতে হবে। আমাদের নিষ্কাশিত ‘ধ্ব’-এর মানে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণও হয়েছিল।’’ সুতরাং, ইংরেজি ভাষায় যে বিষয়ের (ধ্বনি)-র উপর সিলেবল-এর সংজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত, তাই যেহেতু বাংলাভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তাই এর প্রথম প্রত্যয় নিষ্ক্রিয় করা গেল।

এবার আসুন দেখা যাক, সিলেবলের পরিমাপ নিয়ে আমাদের ভিতর কি তর্ক হয়েছিল। কবি, ছান্দসিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে আমি বলেছিলাম, “এক কথায় বলতে পারি, কোনও-কিছু উচ্চারণ করতে গিয়ে নূন্যতম চেষ্টায় যেটুকু আমরা বলতে পারি, তাই হচ্ছে সিলেবল। সেই দিক থেকে এক-একটি সিলেবল হচ্ছে আমাদের উচ্চারণের এক-একটি ইউনিট কিংবা একক।’’ কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এর সমালোচনা করে বলেছিলেন, “এই ডেফিনিশনে “কোনো-কিছু’’ কোনো অর্থ বহন করে না। সিলাবল হল: একটা “স্বরধ্বনি’’ উচ্চারণের কাল, যে স্বরধ্বনির আগেপিছে যে-কোনো-সংখ্যক ব্যঞ্জনধ্বনি থাকতে পারে।’’ আর আপনি বলেছিলেন, “আমি সংজ্ঞাটিকে এভাবে ভাবি : দুইটি পূর্ণ স্বরধ্বনি উচ্চারণের আগ পর্যন্ত যা কিছু উচ্চারণ করা হয় তাই একটি সিলেবল বা অক্ষর।’’

এখন syllable-এর ধারণা যেহেতু ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে, সুতরাং খোদ ইংরেজি অভিধান ও ব্যাকরণবিদগণ একে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেন এবং এর পরিমাপ সম্পর্কে কি ব্যাখা দেন, চলুন তার খোঁজ-খবর করি। “Syllable শব্দটি (তার আদি গ্রীক রূপ syllabe-এর ব্যুৎপত্তি অনুসারে) ‘কয়েকটির- সমষ্টিকে’ বোঝায়, ইংরেজিতে যাকে few বা some বলা হয়। যে অর্থে syllable শব্দটি ইংরেজিতে ব্যবহার হয়, তার কোনো সুস্পষ্ট অর্থ নেই। Chambers Dictionary ‘syllable’ শব্দের অর্থ দিয়েছে ‘a word or part of a word uttered by a (more or less) single effort of the voice, and into which a word can be divided for the purposes of linguistic analysis’। ‘more or less’- এই phrase-টিতে অস্পষ্টতার ছায়া সুস্পষ্ট। তাছাড়া vowel-এর ঠিক কতটা উপস্থিতি আবশ্যিক তারও ইঙ্গিত নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় marble, hurtle, chuckle প্রভৃতি শব্দে -ble, -tle,-ckle প্রভৃতিকে তত্তদ্ শব্দের দ্বিতীয় syllable হিসেবে ধরতে হয় metre (মাত্রা/ ছন্দ) বিচারের কালে, যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই ‘e’ অনুচ্চারিত এবং vowel-এর উপস্থিতি প্রায় শূন্যমাত্রায়। Oxford University Press-এর ছাপা Advanced Dictionary of Current English, 2nd Edition (1963)- র মতো গ্রন্থ পর্যন্ত ঠিক এইরকম syllable ভাগ দেখিয়েছে। Princeton Encyclopedia of Poetry and Poetics, Enlarged Edition 1975-তে syllable-এর সংজ্ঞা দেওয়া আছে এই রকম – “Linguistically, the domain of any degree of accent in spoken utterance, the syllable is the smallest measurable unit of poetic sound, the fundamental building-block of metrical structure...’ (p. 832) গ্রন্থটি অন্যত্র আরও জানায় – ‘In most languages the syllabic center is typically a vowel (v), which may or may not have consonant (c) accompaniment before and (less generally) after. In such languages it is exceptional, but in most not impossible, that syllabic centers be consonantal (Psst!); but in some languages, like the Japanese, a single consonant may be a syllable (pp. 673-4)”। অথচ ঐ syllable যেন একটি সুনির্দিষ্ট আওয়াজ বা শব্দখণ্ড, এমন ধরে নিয়ে বাংলা ব্যাকরণের সুনির্দিষ্ট ক্রিয়াভিত্তিক (বর্ণভিত্তিক) পরিভাষাকে, এক্ষেত্রে ‘অক্ষর’-কে, অনির্দিষ্ট ইংরেজি পারিভাষিক অর্থে পরিণত করে দিতে সুনীতিবাবুর কষ্ট হয়নি। এমনকি sound laboratory-তে যদি যন্ত্রের সাহায্যে কবিতাপাঠের প্রতিকৃতি নেওয়া হয়, তবে প্রায়ই মনে হবে syllable বলে কিছু নেই; কেননা যেখানে ভাবা হয়েছিল syllable-এর শেষ, অন্য syllable-এর আরম্ভ, সেখানে পাওয়া যায় ‘a continuum of voice’।’’ (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)

উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এবার আসা যাক, সিলেবল-কে ‘অক্ষর’ বলে মানতে বাধা কোথায়?“স.বা. অভিধানে দেখা যায়, ‘অক্ষর’ শব্দটির মানে দেওয়া আছে – বর্ণ, যার ক্ষরণ নেই অর্থাৎ ব্রহ্ম, পরমাত্মা, শিব, বিষ্ণু, আকাশ, (ছন্দে) একেবারে উচ্চারণসাধ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ, syllable, (বীজগনিতে) অঙ্কের প্রতীকরূপে ব্যবহূত বর্ণ, ক্ষরণহীন। বা. বা. অভিধান ‘অক্ষর’-এর মানে দিয়েছে এই রকম – ক্ষরণশূন্য, স্থিতিশীল, বর্ণ, হরফ, letter,(ছন্দে) একেবারে উচ্চারণযোগ্য শব্দের ক্ষুদ্রতম অংশ, syllable, সিসা নির্মিত হরফ, type। এমনকি বামন শিবরাম আপ্তে-র ‘Sanskrit English Dictionary’ -তেও ‘অক্ষর’ শব্দের মানে দেওয়া হয়েছে -- imperishable, fixed, Siva, Vishnu, letter of alphabet, syllable, word of words … ইত্যাদি।

হরিচরণ কিন্তু তা করেন নি। তিনি ‘অক্ষর’ শব্দটিকে – অ-ক্ষর, অক্ষ-র – দুরকমভাবে বুঝেছেন এবং আমাদের বিচারে ঠিকই বুঝেছেন। প্রথমটির মূলে রয়েছে ‘ক্ষ’ ক্রিয়া (ক্ষইয়ে দেওয়া, ক্ষরিত হওয়া), দ্বিতীয়টির মূলে রয়েছে ‘অশ্’ ক্রিয়া (সর্বদিকে সমভাবে শক্তিবিচ্ছুরণ ক্রিয়া বা ছড়িয়ে পড়া)। তাই, তাঁর কোষগ্রন্থে ‘অক্ষর’ শব্দটির ভুক্তি ঘটেছে দুবার। প্রথমবারে সেটি অ-ক্ষর। তাই তিনি তার ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন – ‘যাহা ক্ষরিত বা নষ্ট হয় না’; এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছেন স্থির, ধ্রুব, ক্রিয়াশূন্য, কূটস্থ, শিব, বিষ্ণু …ইত্যাদি ১০ টি। আর দ্বিতীয়বারে সেটি অক্ষ-র। তাই তার ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ দিয়েছেন – ‘যাহা বেদাদি ব্যাপ্ত করে’ (ছড়িয়ে দেয়); এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছেন স্বরবর্ণ, স্বর বা স্বরসহিতব্যঞ্জন, বর্ণনির্মাণ ... ইত্যাদি পাঁচটি। আজ আমরা জানি, ‘যাহার দ্বারা বিদিত হওয়া যায়’, তেমন ‘দিশামুখী জ্ঞান’কে বেদ বলে এবং সেই বেদকে ব্যাপ্ত করে ‘অশ্-কারী’ অক্ষর। এই ‘অক্ষর’ স্বভাবতই মানুষের কথিত জ্ঞানপূর্ণ বয়ানের স্বর, যার ভিতরে মানুষের ‘স্ব’ বা আমিত্ব ‘রহে’ (র)। এই ‘অক্ষর’-কে হরিচরণ সেকারণেই ‘স্বরবর্ণ ... ইত্যাদি বলেছেন।” (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)

আমরা যে ‘অক্ষর’ নিয়ে তর্ক করছি তা’হল অক্ষ-র, অ-ক্ষর নয়। তাই ‘অক্ষর’ মানে ‘যাহা ক্ষরিত বা নষ্ট হয় না’ অথবা ‘ক্ষরণ নাই যাহাতে’ এইসব অর্থ এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু যে কথা প্রাসঙ্গিক তা’হল, যে ‘অর্থহীন ধ্বনিসমষ্টির মৃত আওয়াজ’- কে ইংরেজ পণ্ডিত এবং তার অন্ধ অনুসারী সুনীতিবাবু syllable নামে সংজ্ঞায়িত করেন, তা কিভাবে বাংলা ভাষার ‘অক্ষর’ নামক সুনির্দিষ্ট অর্থবহনকারী শব্দের সমার্থক হবে? এসম্পর্কে সিদ্ধান্তসূচক উপসংহার তাই কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর বক্তব্য উপস্থাপন করে সারতে চাইঃ “ syllable ধারণাটি পশ্চিমে গড়ে উঠেছে, শব্দাবলীকে অর্থরহিত ক’রে, শুধু আওয়াজ হিসেবে তাদের খণ্ড খণ্ড করে দেখার মধ্যে দিয়ে। আমাদের বাংলা ভাষায় ‘শব্দাংশ’ কথাটিই এর অনুষঙ্গে যথার্থ হবে; কেননা; ‘শব্দ’-এর ভিতরে ঘটনার ‘শব’ থাকে, যা মৃতদেহ মাত্র। হরিচরণও syllable-এর প্রতিশব্দ রূপে ‘শব্দাংশ’ই ব্যবহার করেছেন এবং ঠিক করেছেন। কিন্তু তা না করে, আমাদের অবিনশ্বরাত্মক বা ব্যাপকার্থক ‘অক্ষর’- কে ওদের syllable-এর সঙ্গে জোর করে মিলিয়ে ছেড়ে দিলে syllable টিকে যেতে পারে, কিন্তু ‘অক্ষর’ প্রাণে বাঁচে না।’’ (শব্দার্থ পরিক্রমা, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী)

আমি এর সাথে শুধু এটুকুই যোগ করতে চাই যে, ‘শব্দাংশ’ যদি syllable হয়, তা’হলে ‘পদাংশ’ বা ‘দল’ ইত্যাদিও যুক্তিসঙ্গত কারণেই পাশাপাশি গৃহীত হবে, এটাই স্বাভাবিক।

এবার আসা যাক উচ্চারণ এবং এ সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ে। গালিব বলছেন, “উপরন্তু, আপনি যখন ঈ=ই+ই বলে ‘ঈ’-এর মধ্যে দুইটি স্বরধ্বনি সন্ধান করেন, তখন আরেকবার মূর্খতা অট্টহাস্য দিয়ে ওঠে।ওটা পৃথক দুইটি স্বরধ্বনির যোগফল নয়, উচ্চারণের হ্রস্বতা ও দীর্ঘতার মামলা। আবদুল হাই মনোযোগ দিয়ে পড়েন, ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।” আপনার এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, বিষয়টা শুধু উচ্চারণের হ্রস্বতা ও দীর্ঘতার মামলাই নয়, অর্থের মামলাও বটে। কিভাবে তা অর্থের মামলা সে উদাহরণ দেবার আগে, দেখা যাক হাই সাহেব ইংরেজি শিক্ষার কুপ্রভাবে বাংলা ভাষায় এই দীর্ঘ ও হ্রস্ব স্বরের কি ব্যাখা করেছিলেন এবং তা কেন ত্রুটিপূর্ণ। উদ্ধৃতিঃ ‘... মূলধ্বনি হিসেবে ইংরেজির feel, seed, seat প্রভৃতি শব্দে দীর্ঘ ‘i’ (ঈ) এবং fool, cool প্রভৃতি শব্দের দীর্ঘ ‘u’ (ঊ)-র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইংরেজিতে আভিধানিক পর্যায়ে দীর্ঘ ‘i’ এবং দীর্ঘ ‘u’ হ্রস্ব ‘i’ এবং হ্রস্ব ‘u’ সমন্বিত শব্দকে অর্থের দিক থেকে পৃথক করে দেয়। তুলণীয় feel এবং fill, fool এবং full শব্দাবলী। বাংলা হরফে হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ, হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ আমরা লিখলে মূলধ্বনি হিসেবে ঈ এবং ঊ-এর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ ইংরেজির মত বাংলার হ্রস্ব ই এবং দীর্ঘ ঈ কিংবা হ্রস্ব উ এবং দীর্ঘ ঊ দিয়ে অন্যান্য ধ্বনি ঠিক রেখে দুটো স্বতন্ত্র শব্দ পাই না। বাংলা স্বরধ্বনিতে মূলস্বরধ্বনি হিসেবে হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ ই এবং হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ উ-এর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। প্রশ্ন ওঠে শুধু ই-জাতীয় একটি ধ্বনির এবং উ-জাতীয় একটি ধ্বনির। বাংলায় মূলধ্বনি হিসেবে ই এবং উ-এর দীর্ঘত্ব কোনো স্বতন্ত্র ধ্বনিগুলোর সৃষ্টি করে না।...’’ (ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই, পৃষ্ঠা ২৩২)

এবার আসুন দেখা যাক, নিম্নের উদাহরণগুলো কি বলে?

গিরি + ইন্দ্র = গিরীন্দ্র

গিরি = পর্বত, ইন্দ্র = ইন্দ্র নামের কোনো দেবতা। কিন্তু ‘গিরীন্দ্র’ বলতে আমরা বুঝি গিরিদের ইন্দ্র, অর্থাৎ গিরিশ্রেষ্ঠ বা সর্বোচ্চ পর্বতকে। এখানে গিরি-র ‘ই’ এবং ইন্দ্র-র ‘ই’ স্বরধ্বনি দুটো যুক্ত হয়ে দীর্ঘ ‘ঈ’ স্বরধ্বনি তৈরী করে এবং তা পৃথক দুটো শব্দের মধ্যে সন্ধির ফলাফল হিসেবে বিরাজ করে নতুন শব্দের (গিরীন্দ্র) জন্মকে সম্ভব করে তোলে। একারণেই ‘তির তির’ করে জল বয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড়কে ‘তীর’ বলে এবং ‘কুল কুল’ করে জল বয়ে যাওয়া নদীর দুই পাড়কে ‘কূল’ বলে। ‘তির তির’ এবং ‘কুল কুল’ জল(ধ্বনি)র অন্তর্গত ‘ই’ এবং ‘উ’ ধ্বনিকে তাই চাইলেই নিতান্ত উচ্চারণের মামলা বলে দীর্ঘ ‘ঈ’ অথবা দীর্ঘ ‘ঊ’ হিসেবে উচ্চারণ করা যায় না, কেননা তাতে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। বহমান জলপ্রবাহ যাত্রীদের নদী পারাপারে সাহায্য না করে বরং নদীর পারে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখে। আশা করি হাই সাহেবের ভ্রান্তি কোথায়, এবার তা পরিস্কার হয়েছে।

অবশেষে উচ্চারণের প্রসঙ্গ টেনে আপনি ছন্দ বিষয়ে আপনার অভিমত প্রকাশ করেন, “উচ্চারণেই দৈর্ঘ্যের সঙ্গে এর একটি গুপ্ত সম্পর্ক আছে।’’ আপনি অভিনিধানের প্রসঙ্গ টেনে ব্যাখা করতে চেয়েছেন, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রচলিত হিসাব অনুযায়ী ‘কৃষ্ণের’ এবং ‘উৎসুক’ শব্দ দুটিকে তিন মাত্রার পরিবর্তে কেন উচ্চারণের স্বাধীনতা গ্রহণ করে চারমাত্রা পড়া যায় ... “কবি যখন ‘কৃষ্ণের’ শব্দটা চারমাত্রা গণনা করতে চান, বুঝতে হবে তখন তিনি শব্দের উচ্চারণ আশা করছেন এমন: কৃশশ+নের। অর্থাৎ শিসধ্বনিটার উচ্চারণকে প্রলম্বিত করতে চাইছেন। একইভাবে, উৎ+সুক -- এখানে কবি 'উৎ' বলে পলমাত্র থামতে চাইছেন। এই আর কি।”

প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের উচ্চারণের স্বাভাবিক ঝোঁক অনুযায়ী, ‘কৃষ্ণ’ শব্দের ‘কৃষ্’ উচ্চারিত হবে দ্রুত, তাকে টেনে পড়তে যাব কেন? সেটা কি তাহলে ছন্দে যাতে চারমাত্রা পাওয়া যায়, সে জন্য আরোপ করতে হবে? এবং একইভাবে ‘উৎসুক’ শব্দে ‘উৎ’-এর উচ্চারণের পর পলমাত্র থামারও কোনো সঙ্গত কারণ নেই। কবি নিজেও তেমন দাবী করেন না। এখন যদি আপনার কথামত আমরা তা বিবেচনায় নিতে যাই, বাংলা ভাষার স্বভাব কি তা অনুমোদন করে? উত্তর – না! মজার ব্যাপার হ’ল হাই সাহেবের বক্তব্য এক্ষেত্রে আমার মতকেই সমর্থন করে। হাই সাহেব ঐতিহ্যগতভাবে সুনীতি অনুসারী হলেও, বহু ক্ষেত্রেই অনেক বেশী সৃজনশীলতা ও দূরদর্শীতার প্রমাণ দিয়েছেন। সে যা হোক, হাই সাহেবের বক্তব্য কিভাবে আমার মতকে সমর্থন করে বোঝার জন্য আসুন দেখি, হাই সাহেব সাধারণভাবে ভাষার স্বভাব-প্রকৃতি এবং বাংলা ভাষায় তার আচরণ সম্পর্কে কি বলেন?

‘... নদীস্রোতে যেমন নানা তরঙ্গ উঠে, মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনিতেও তেমনি সেই তরঙ্গেরই লীলা। তা-ই ভাষা ধ্বনিগুণের সুক্ষ্ম ও জটিলতম দিককে উদ্ঘাটিত করে দেয়। ধ্বনির এ সূক্ষ্ম সুন্দর সামগ্রিক গুণ একদিকে যেমন অনুভূতি সাপেক্ষ, অন্যদিকে তেমনি বিশেষণাতীত। এদিক থেকে সামগ্রিক ধ্বনিপ্রবাহের মধ্যে দৈর্ঘ্য (length), ঝোঁক (stress), শ্রুতদ্যোতকতা (prominence), জোর (emphasis), ধ্বনিতরঙ্গ (intonation) প্রভৃতি গুণই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।’’(ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব, মুহম্মদ আবদুল হাই, পৃষ্ঠা ২৩১)

অন্যত্র এই length-কে বলা হয়েছে quantity, duration আর stress-কে বলা হয়েছে accent। length -কে দৈর্ঘ্য, সার্থপর্ব, স্থিতিগত, পরিমাপগত ইত্যাদি যেমন বলা হয়, তেমনি stress, accent-কে শ্বাসাঘাত, ঝোঁক, শ্বাসপর্ব, প্রস্বন, প্রচাপন, বল ইত্যাদিও বলেছেন আবদুল হাই। বলেছেন, “বাংলা-বাকপ্রবাহে দুরকম পদবিন্যাস দেখি। একটি সার্থপর্ব এবং অন্যটি শ্বাসপর্ব। (পৃষ্ঠা ২৪২) ... দৈর্ঘ্যের মত stress ধ্বনিকে গুণময় করে। ধ্বনির নানাগুণে বাকপ্রবাহ গুণান্বিত হয়। বাকপ্রবাহের অন্যান্য গুণ থেকে ধ্বনিসংশ্লিষ্ট শ্বাস-প্রক্ষেপণের জোরটুকুকে কোনক্রমে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে যা পাওয়া যায় তাকেই stress বা accent নামে অভিহিত করা যায়। (পৃষ্ঠা ২৪২) ... ইংরেজি, জার্মান, স্পেনিয়, গ্রীক এবং সোয়াহিলী প্রভৃতি ভাষায় বিভিন্ন শব্দে (words in isolation) এ ধরনের শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তনের সাহায্যে একই শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহূত হওয়ায় এবং পৃথক পৃথক শব্দে শ্বাসাঘাতের বহুল প্রচলন থাকায় এগুলোকে ‘stress language’ বা শ্বাসাঘাতপ্রধান ভাষা বলা হয়। বাক্যে পার্শ্ববর্তী শব্দ কিংবা শব্দাবলীর তুলনায় কোনো শব্দের অর্থে আবেগের গভীরতা কিংবা কোনো বৈপরীত্য (contrast) সৃষ্টির জন্যে সাধারণত শ্বাসাঘাতের ব্যবহার করা হয়। বাক্যের বৃহত্তর প্রয়োজনে সেজন্য শব্দের নির্ধারিত শ্বাসাঘাত কখনও লুপ্ত হয়, কখনও স্থান পরিবর্তন করে আর কখনও বা অক্ষুণ্ন থাকে। ইংরেজির মত বাংলা stress বা শ্বাসাঘাত প্রধান ভাষা নয়। এমন কি বাংলায় একই শব্দে শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তনের ফলে ইংরেজির মত বিভিন্ন অর্থ উদ্রিক্ত করার অবকাশও নেই। সেজন্য জাপানি, হিন্দুস্থানী, মারাঠি প্রভৃতি ভাষার মত বাংলাকে Stressless language তথা শ্বাসাঘাতহীন ভাষা বলা হয়।…” (পৃষ্ঠা ২৪৩)। মোট কথা মুহম্মদ আবদুল হাই এমন অনেক কথা বলেছেন, যাতে বোঝা যায়, তিনি যদি পদার্থবিজ্ঞানের (Physics) কণাতরঙ্গ ব্যাপারটি জানতেন, তাহলে হয়তো তিনিই বলে যেতেন যে, ইংরেজ কণাপ্রধান ভাষাতে কথা বলে, আমরা বাংলাভাষীরা তরঙ্গপ্রধান ভাষাতে কথা বলি।

এজন্য হাই সাহেবের কথার সূত্র ধরেই বলি যে, বাংলা ভাষায় ইচ্ছে করলেই শ্বাসাঘাতের স্থান পরিবর্তন করতে পারি না, কেননা তার কোনো অর্থ হয় না এবং বাংলা ভাষার স্বভাব তা অনুমোদন করে না। তাই ‘কৃষ্ণের’ এবং ‘উৎসুক’ শব্দ দুটোকে খেয়াল খুশীমত টেনে বা থেমে উচ্চারণ করে চার মাত্রার লাইসেন্স দেয়া যায় না।

এ আলোচনার উদ্দেশ্য অহং-এর বিজয় নয়, বরং কাল পরিক্রমায় পরিবর্তশীল বাংলাভাষার পূর্বাপর ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে ভাষার ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে যথাসম্ভব ভ্রান্তিহীন থাকার একান্ত আকাঙ্ক্ষা। সবাইকে এ আলোচনা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর ‘শব্দার্থ পরিক্রমা’ নিবন্ধটি ও এযাবত কাল পর্যন্ত তাঁদের চিন্তাভাবনার সার সংক্ষেপ যে ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে তার লিঙ্কঃ http://www.banglasemantics.net/works.html


কবি তুষার গায়েনের নোটটির লিংক-
http://www.facebook.com/notes.php?drafts&id=1573787229#/note.php?note_id=234284085124&ref=mf

Monday, April 27, 2009

তুষার গায়েনের কবিতা

যে রূপ আমি শুনিলাম কানে

মালিনী মাসির হাসি, নিলাজ গুঞ্জন তুলে আনে
আনন্দিত শিহরণ এই ভীত মনে- সরোবরে
ছায়া প’ড়ে আছে তার এ অমোচনীয় আঠার প্রলেপ
বায়ুযোগে ঢেউ উঠে গোল হয়ে, সরে যায় দূর
গোলাকার তলে- তবু রূপ তার হাসিতে অনড়
বেড়ালের মত এই অপরাহ্ণ বেলা!

নিবিড় নৈঃশব্দ চারিদিকে, ফুল ফোটাবার যত
আয়োজন গাঢ় প্ররোচনা করে যায় ঝিঝিদেঁর
দল, জোনাকিও জোটে এসে- জ্বলে নেভে ঈর্ষাতুর
দূর তারাদের দেখে। যে গেছে চন্দনবনে-

মাসি! তাঁর চোখ তুমি বেঁধে রাখো কেন?
সুরভি কি ঢেকে যায় বলো, আঁচলের তলে?
সখির কাঞ্চনরূপ কালির কলঙ্কে বুঝি মোছে!
হয়েছে, হয়েছে মাসি, তাঁকে দূর থেকে ভালবাসি
দেখি নাই যাকে কোনদিন, তবু তার রূপের কীর্তন
তাঁর, আমি শুনেছি তো কানে!